ঋত্বিক ঘটক: চলচ্চিত্র ছিল তাঁর চিরকালীন বিপ্লবী হাতিয়ার

By মনিরুল ইসলাম:

3 Min Read

আজ (৪ নভেম্বর) বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের জন্মদিন। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) রাজশাহী শহরের মিয়াঁপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব ও কৈশোরের একটি অংশ কাটে তার পৈতৃক বাড়িতে, পরে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর পরিবার কলকাতায় চলে যায়।

ঋত্বিক কুমার ঘটক ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক, বাঙালি শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের কথায়, আমার কাছেই সেইটেই তার সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সবচেয়ে মূল্যবান বৈশিষ্ট্য। ঋত্বিক কতটা নিবিড়ভাবে বাংলার মানুষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার প্রমাণই রায়ের অকপট সাক্ষ্য।

ঋত্বিক কুমার ঘটক ছোটবেলা থেকেই তিনি আলাদা ছিলেন; জীবনকে নিজের মতো করে গড়ে তোলেন, ভেঙে আবার নতুন করে গড়েন। রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যতা, গণনাট্য, নাট্যলেখা, অভিনয়, সাহিত্য  সবকিছুই তাঁর কর্মজীবনের অংশ। ভারতীয় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক ও ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও, সবকিছুর মধ্যেই তিনি মূলত সিনেমাওয়ালা, বাংলা ও বাঙালির সিনেমাওয়ালা।

১৯৪৮ সালে কলকাতার প্যারাডাইস ক্যাফেতে তিনি মৃণাল সেন, তাপস সেন, সলীল চৌধুরী ও অন্যান্য তরুণদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠেন। সিনেমার দিকে আসার কারণ ছিল মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ। নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’-এর কাজের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর নিজের সিনেমার যাত্রা শুরু করেন।

‘নাগরিক’ ছিল তাঁর প্রথম সিনেমা, যা বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনবোধ তুলে ধরে। যদিও এটি ১৯৫২ সালে নির্মিত হলেও মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। ১৯৫৫ সালে আদিবাসীদের জীবন নিয়ে নির্মাণ করেন ডকুমেন্টারি ‘ওঁরাও’। ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অযান্ত্রিক’ বাংলা সিনেমার জগতে এক নতুন দিশা দেখায়। তিনি ছয়–সাতবার স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন করেও সিনেমাটি পরিশ্রমে পরিপূর্ণ করেন।

ঋত্বিকের সিনেমাগুলোতে বাস্তবতা ও মানবিক দুর্বলতার প্রকাশ অপরিসীম। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ইত্যাদি ছবিতে দেশভাগ, শরণার্থী সমস্যা, দারিদ্র্য, মানুষের সংগ্রামের জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ব্যক্তিগত ও সামাজিক বাস্তবতার গভীর প্রতিফলন।

ঋত্বিক সিনেমার মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, মানুষের কষ্টকে তুলে ধরেছেন। তিনি রঙিন অবাস্তবতা দেখাতে চাইতেন না; নিজের চোখে যা দেখেছেন, সেটাই দর্শকের সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁর সিনেমায় পৌরাণিকতা এসেছে শিল্পীর দৃষ্টিতে।

ব্যক্তিগত জীবন ছিল অস্থির, অসুখ ও অভাবের সঙ্গে লড়াই। মৃত্যুর সময় স্ত্রী সুরমাও অনেক দূরে ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তবে এক্সপায়ার্ড ঋত্বিক ঘটক এখনও বাঙালিকে ভাবনার অনুশীলন করাচ্ছেন, ক্রমাগত বলে চলেছেন: ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।

ঋত্বিক ঘটকের জীবন ও সিনেমা আজও বাঙালি সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের জন্য অমর এক প্রেরণা।

- Advertisement -
newsnextbd20
Share This Article
Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *