কাকন বাহিনীর আস্তানায় সেনাবাহিনীর অভিযান, অস্ত্র-টাকাসহ আটক ৩

পাবনার ঈশ্বরদী ও নাটোরের লালপুরে পদ্মা নদী তীরবর্তী এলাকায় আলোচিত ‘কাকন বাহিনী’র সন্ত্রাসী আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা এই যৌথ অভিযানে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদক, ১২ লাখ টাকার বেশি নগদ অর্থ, নির্যাতনের যন্ত্রপাতি এবং চাঁদা আদায়ের বিস্তারিত তালিকা।
আটক ব্যক্তিরা হলেন– কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার সাতবাড়িয়া দক্ষিণ ভবানীপুরের মৃত আজিজুল হকের ছেলে ও আওয়ামী লীগ নেতা কাকনের ভায়রা ভাই মেহেফুজ সোহাগ (৪০), ঈশ্বরদীর আরমবাড়িয়ার মঞ্জুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল ইসলাম বাপ্পি (৩০), এবং লালপুরের কাইগি মারির চর এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া খাতুন (৫৫)। তারা সবাই কাকন বাহিনীর ঘনিষ্ঠ বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
সেনাবাহিনীর পাবনা ও নাটোর ক্যাম্পের সমন্বয়ে পরিচালিত এই অভিযানে সাড়া ঘাট এবং লালপুরের দিয়ার বাহাদুরপুর এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে তিনটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, চাইনিজ কুড়াল, দেশি রাম দা, গুলিভর্তি ম্যাগাজিন, পেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজার গাছ, মোবাইল, সিমকার্ড, একটি মানুষের মাথার খুলি এবং নির্যাতনের কাজে ব্যবহৃত স্টিমরোলার।
সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো উদ্ধার হওয়া দুটি খাতা, যেখানে উল্লেখ আছে কারা কারা চাঁদার টাকা পায়, কত টাকা পায় এবং কীভাবে তা মাসিক বা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ভাগ হয়। উদ্ধারকৃত নথি অনুযায়ী, লক্ষীকুন্ডা নৌ পুলিশ প্রতি মাসে ৪ লাখ টাকা, নাটোরের ডিসি ১ লাখ, সার্কেল এসপি ৫০ হাজার, বাগাতিপাড়া থানার ওসি ২৫ হাজার এবং একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক ২৫ হাজার টাকা পান। এশিয়ান টিভির স্থানীয় প্রতিনিধি পায়েল হোসেন রিন্টুকে প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হতো বলেও তালিকায় উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, নাটোরের লালপুরসহ আশপাশের এলাকায় কাকন বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বালুর ঘাট নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। যদিও সাড়া ঘাটের বৈধ ইজারাদার থাকায় সেখানে তাদের আধিপত্য কায়েম করতে পারেনি। ওই ঘাট দখলে নিতে গিয়ে ৫ জুন ও ১৩ জুলাই ফিল্মি স্টাইলে গুলি চালায় কাকন বাহিনীর সদস্যরা। গত শনিবার গুলিতে গরুর রাখাল সোহান হোসেন আহত হন। এরপর থেকেই এলাকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
আটক মেহেফুজ সোহাগ ও বাপ্পি স্বীকার করেছেন, তারা নৌকা চালানো এবং ক্যাশিয়ারের কাজ করতেন। তারা জানান, কাকন বাহিনী এলাকাটিতে সন্ত্রাস, মাদক সেবন, অস্ত্র ব্যবসা ও নারী নির্যাতনের আখড়া গড়ে তুলেছিল। বাহিনীর সদস্যদের বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ মালামাল।
রাজশাহীর বাঘার বৈধ বালু ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান সরকার বলেন, “আমরা সরকারের অনুমতি নিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা করি। কিন্তু কাকন বাহিনী জোর করে প্রতিটি নৌকা থেকে চাঁদা তোলে। সেনাবাহিনীর অভিযানকে আমি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ মনে করি।”
নাটোরের লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমিনুনজ্জান জানান, লক্ষীকুন্ডা নৌ পুলিশের দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে আটকদের নাটোর কারাগারে পাঠানো হবে।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার খন্দকার আজিম হোসেন ফোনে বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না, পরে খোঁজ নেবেন বলে ফোন কেটে দেন। নাটোরের পুলিশ সুপার আমজাদ হোসেন বলেন, “আমি প্রথম আপনার কাছ থেকেই শুনলাম। যেসব ডকুমেন্ট আছে, দিন, সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এলাকায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন