নেতাদের হাসপাতালে ‘দায়িত্বহীন’ উপস্থিতির সমালোচনা

বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রকাশ: ২১ জুলাই, ২০২৫, ৭:৪১
নেতাদের হাসপাতালে ‘দায়িত্বহীন’ উপস্থিতির সমালোচনা

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনায় যখন আহত শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতার আগমন ঘটেছে, যা তৈরি করেছে বিশৃঙ্খলা, বাড়িয়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি। চিকিৎসকদের অনুরোধ উপেক্ষা করে নেতাদের প্রবেশ এবং অনুসারীদের ভিড় সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে, এই মুহূর্তে তাদের ভূমিকা আসলে কতটা প্রয়োজনীয়?

সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে দুর্ঘটনার পর আহত শিশুদের একে একে অ্যাম্বুলেন্সে করে আনা হয় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। তখনই শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের আগমন। বিকেল ৩টা থেকে রাত পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটের চত্বরে ভিড় করেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা এবং তাদের সঙ্গে আসা শতাধিক কর্মী-সমর্থক। দেখা গেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সরব উপস্থিতি।

চিকিৎসকরা বারবার অনুরোধ জানালেও সেই ভিড় কিছুতেই থামেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, রোগীর স্বজন এবং স্বেচ্ছাসেবীদের ভাষ্য নেতাদের গাড়ি, প্রটোকল, নিরাপত্তাকর্মী ও অনুসারীদের কারণে হাসপাতালের প্রবেশপথ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্স থামতে বাধ্য হয়, জরুরি রোগী পরিবহনে তৈরি হয় বিঘ্ন।

বিশেষ করে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে ভিড় করে আসা শতাধিক নেতা-কর্মী হাসপাতালের সামনের জায়গা দখল করে ফেলেন। মির্জা ফখরুল নিজেই এক পর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্সের পথ করে দিতে বাধ্য হন।

এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান ডা. মারুফ আলম চৌধুরী ভিডিও বার্তায় অনুরোধ করেন, আপনারা যত বেশি আসবেন, শিশুদের সংক্রমণের ঝুঁকি তত বাড়বে। এ মুহূর্তে ভালোবাসা মানে দূরে থেকে দোয়া করা।

প্লাস্টিক সার্জন ডা. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, পোড়া রোগীর জন্য সংক্রমণই সবচেয়ে বড় হুমকি। জীবাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়া কারও ভেতরে যাওয়া ঠিক নয়।

দুঃখজনকভাবে, এমন সতর্কতা উপেক্ষা করে হাসপাতালে প্রবেশ করেন একাধিক রাজনৈতিক নেতা। এক নারী চিকিৎসককে হাতজোড় করে অনুরোধ করতে দেখা যায় ভিড় কমাতে, কিন্তু তা সাড়া পায়নি।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও গণমাধ্যমে বলেন, এই শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি নেই। আমাদের শরীর থেকে যদি কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তার দায় কার?

ঘটনাস্থলে রক্তদানে আসা অনেক সাধারণ মানুষ এবং রোগীর স্বজনরা নেতাদের এমন ‘পর্যবেক্ষণমূলক’ উপস্থিতিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়া ভিডিও, লাইভ স্ট্রিম ও ছবি ঘিরে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। কেউ কেউ বলছেন, মানবিকতা দেখাতে গিয়ে আরও বিপদ বাড়ানো উচিত নয়।

সন্ধ্যার পর বার্ন ইনস্টিটিউট চত্বর হয়ে ওঠে একরকম জনসমুদ্র। নেতাদের সঙ্গে আসা কর্মী, সংবাদকর্মী, ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, এমনকি উৎসুক জনতাও সেখানে ঢল নামে। এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তা কর্মীদের।

এমন এক সংকটময় সময়ে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছেন চিকিৎসকরা, স্বজনরা এবং নাগরিক সমাজ। কারণ, একজন রোগীকে রক্ষা করতে হলে তার চারপাশকে আগে নিরাপদ রাখতে হয়।