বাংলাদেশে যে জীবন শ্রমিকের

জোবায়ের আহমেদ
প্রকাশ: ১ মে, ২০২৫, ৫:১৪
বাংলাদেশে যে জীবন শ্রমিকের

ফজরের আজানের ঠিক আগমুহূর্তে ঘুম ভাঙে গার্মেন্টকর্মী জুলেখার। রাজধানীর মিরপুরে এক কামরার ছোট ঘরে তিন সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে তার সংসার। কাজ শুরু সকাল ৮টায়, কিন্তু রান্না-বাচ্চাদের স্কুলের প্রস্তুতি শেষে কারখানায় পৌঁছাতে দৌড়াতে হয় সকাল ৭টার আগেই। মাস শেষে বেতন ১৩,৫০০ টাকা। বাড়িভাড়া, চাল-ডাল-তেল, স্কুলের ফি—সবকিছু মেলাতে গিয়ে প্রতিমাসেই হিমশিম খেতে হয়।

এই জুলেখার জীবনই যেন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের প্রতিচ্ছবি।

একটি গবেষণা বলছে, দেশের ৬২ শতাংশ শ্রমিক এখনও ন্যূনতম জীবিকা নির্বাহের উপযোগী মজুরি পান না। পোশাক, নির্মাণ, কৃষি, পরিবহন ও চামড়া শিল্পে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক দিনে ১০–১২ ঘণ্টা কাজ করেও পরিবার নিয়ে টিকে থাকতে পারছেন না। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও আবাসন—এই তিনটি মৌলিক চাহিদা তাদের কাছে এখনো স্বপ্নের মতো।

স্বপ্ন আর বাস্তবতার সংঘাত যেন এক দীর্ঘ নিয়তি। খুলনার বটিয়াঘাটার রিকশাচালক সেকান্দার আলী ছিলেন দিনমজুর। এখন তিনি শহরের রাস্তায় রিকশা চালান। তার চোখে পানি আসে যখন জিজ্ঞেস করা হয়— আপনার সন্তানেরা স্কুলে যায় কি না? উত্তর আসে ‘বড় ছেলে কাজে গ্যাছে রাজমিস্ত্রির সাথে। মাইয়াডা পড়ত, কিন্তু খরচ চালাইতে পারলাম না’ —কণ্ঠে হতাশা, লজ্জা আর চাপা ক্ষোভ।

ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের এক গার্মেন্ট কর্মী বলেন, ‘আমাদেরে মানুষ মনে করে না। ঈদের বোনাস দিতেও গড়িমসি করে, অথচ সময়মতো কাজ না করলে গালি দ্যায়।’

তার সাথে আছে নিরাপত্তাহীনতা আর নিয়োগ অনিশ্চয়তা। অনেক শ্রমিক এখনো মৌখিক চুক্তিতে চাকরি করেন। শ্রম আইন অনুযায়ী নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। ফলে ছাঁটাই, দুর্ঘটনা কিংবা শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ শ্রমিক বিচার পায় না।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের পরে বিশ্বের নজর পড়েছিল বাংলাদেশের শ্রম খাতে। কিছু সংস্কার হলেও মাঠপর্যায়ে শ্রমিকের অবস্থা খুব একটা বদলায়নি। বেতন কাঠামো কিংবা কারখানার নিরাপত্তা—দুটিই এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।

এত সব অভাব-অভিযোগের মধ্যেও শ্রমজীবী মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যান না। তাদের আশা, একদিন সরকার এবং সমাজ তাদের সম্মানের চোখে দেখবে। মজুরি বাড়বে, সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা হবে, আর বয়স হলে কিছু নিশ্চয়তা থাকবে।

বগুড়ার ব্রিক ফিল্ডে কাজ করা রাশেদা বেগম বলেন, আমার মাইয়া ডাক্তার হইবো, আমাগো মত এত কষ্ট করবো না। এই একবাক্যই যেন শ্রমিক জীবনের আশা-হতাশার সবচেয়ে সুন্দর সংলাপ।

মে দিবস আসলে একদিনের উৎসব নয়, বরং এক দীর্ঘ যাত্রার প্রতীক—একটি সংগ্রামের দিন। বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রমজীবী মানুষের ঘাম আর রক্তে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তারা এখনও সমাজে অবহেলিত।

‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’—এই প্রতিপাদ্য যেন কেবল পোস্টারে সীমাবদ্ধ না থাকে, বাস্তবেও প্রতিফলিত হয়—এই হোক আমাদের সামষ্টিক প্রত্যয়।