ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: উপমহাদেশ কি শান্তির আশ্রয় হারাচ্ছে?

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। নিয়ন্ত্রণ রেখায় গোলাগুলি, পাল্টা বিমান হামলার হুমকি, যুদ্ধের প্রস্তুতির বার্তা—সবই পূর্বপরিচিত দৃশ্যপট। কিন্তু এই উত্তেজনার পেছনে শুধু ভূরাজনীতি নয়, নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন, জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা এবং রাজনৈতিক ফায়দা তোলার ভয়ঙ্কর প্রবণতা।
যুদ্ধের নেপথ্যে ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবহার কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বারবার মুসলিম নিপীড়নের অভিযোগ তুলছেন। তারা একে ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে প্রচার করছেন।
অন্যদিকে, ভারতের কিছু চরমপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন কাশ্মীরকে ‘হিন্দু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে তুলে ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জয়গান গাইছে।
ভারতের একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রচারনায় বলা হয়েছে, ‘কাশ্মীর আমাদের রাম জন্মভূমির অংশ, এখানে জিহাদের স্থান নেই’ । অন্যদিকে পাকিস্তানে জুমার খুতবায় কাশ্মীর ইস্যুকে ‘ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্বের প্রশ্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
তবে এই উত্তেজনায় একপেশে না থেকে অনেক ধর্মীয় চিন্তাবিদ ও আলেম-উলামা উভয় দেশেই ধর্মের প্রকৃত বার্তা স্মরণ করাচ্ছেন। ইসলামি চিন্তাবিদ ড. ইসমাইল শাহ বলেন:
ইসলাম কোনো আগ্রাসনের অনুমতি দেয় না। যুদ্ধ শুধু আত্মরক্ষার জন্য, তা-ও সীমিত মাত্রায়। যারা ধর্মের নামে যুদ্ধ উসকে দেয়, তারা কুরআনের প্রকৃত চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করছে।
হিন্দু ধর্মগুরু স্বামী আনন্দদেব সরস্বতী বলেন:
ধর্ম মানেই মঙ্গল। রাম, কৃষ্ণ কিংবা গীতা—সবই বলেছে আত্মসংযম, অহিংসা, সহনশীলতা। যুদ্ধ নয়, আমরা শান্তি চাই।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ধর্মীয় ভিত্তিতে যে বিভক্তির সূচনা হয়, তা একাধিক যুদ্ধের জন্ম দেয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক, তবে ধর্মীয় পরিচয়ের ব্যবহার সেখানে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অস্ত্র হয়েছিল।
১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময়ও ধর্মীয় উত্তেজনা উস্কে দেওয়া হয়েছিল উভয় দিক থেকেই। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে দেখা গেছে—ধর্মের নামে যুদ্ধ শুরু হলে, তার প্রধান শিকার হয় সাধারণ, নিরীহ, ধর্মপ্রাণ মানুষ।
সামাজিক মাধ্যমেও আলোচনায় উঠে এসেছে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সর্বশেষ যুদ্ধের শিক্ষা। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের উদাহরণ দেখায়, শান্তিপূর্ণ সমাধানই প্রকৃত বিজয়।
অন্যদিকে, মহাভারতের যুদ্ধ শেষে অর্জুন যখন হতাশ হন, কৃষ্ণ তাকে বলেন: “যুদ্ধ নয়, জ্ঞান ও আত্মসংযমই পরম ধর্ম”। এমন পোস্টও দেখা গেছে তরুণ ভারতীয়দের ফেসবুক ও এক্সে।
রাজনৈতিক ফায়দার প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—এই যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে। অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, দুর্নীতি—এসব বিষয় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য ধর্ম ও দেশপ্রেমের মোড়কে যুদ্ধের ঢোল বাজানো হচ্ছে।
পাকিস্তানের সাংবাদিক হামিদ মীর এক কলামে লিখেছেন:
যুদ্ধ কেউ চায় না। কিন্তু ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের নামে যুদ্ধে বাধ্য করা হচ্ছে আমাদের।
উভয় দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা যদি ধর্মকে যুদ্ধের অস্ত্র বানায়, তবে হারাবে শুধু শান্তিকামী জনগণ। অথচ ইসলাম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম বা খ্রিস্টান ধর্ম—সবই বলেছে করুণা ও সহানুভূতির কথা।
আপনার মতামত লিখুন