সমবায় ব্যাংকের ফ্লোর বিক্রি করে সাবেক চেয়ারম্যানের সম্পদ পাহাড়

ঢাকা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লি: এর সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম, ছবি - সংগৃহীত।
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ভিত্তিতে ১৯০৯ সালে নওয়াব পরিবারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড আজ দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সমবায় মন্ত্রণালয় ও নিবন্ধকের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাংকের দুটি ফ্লোর বিক্রি করে অন্তত ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে। একাধিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দায়ের করা অভিযোগে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বেআইনিভাবে ফ্লোর বিক্রি, দামে কারসাজি
সমবায় অধিদপ্তরের ২০১৯-২০ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, আব্দুল আলীম ও তৎকালীন প্রিন্সিপাল অফিসার মো. আতাউর রহমানের যোগসাজশে ২য় তলার ২১০০ বর্গফুট ফ্লোর বেআইনিভাবে মাত্র ৪৮০০ টাকা বর্গফুট দরে বিক্রি করা হয়। যেখানে ওই এলাকার প্রকৃত বাজারমূল্য ছিল প্রতি বর্গফুট ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা।
চুক্তিপত্র সম্পাদনের পর গোপনে পজেশন হস্তান্তর করা হয়। ১.২৬ কোটি টাকার চুক্তি হলেও ব্যাংকে জমা পড়ে মাত্র ১.১৭ কোটি টাকা। বাকি ৯ লাখ টাকা কোথায় গেছে, তার কোনো হিসাব নেই।
এরপর ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট ব্যাংকের ৪র্থ তলার দক্ষিণাংশের ১৩১৫ বর্গফুট জায়গা মাত্র ৩০ লাখ টাকায় নুরুজ্জামান শিকদার নামে এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হয়, নিবন্ধকের অনুমোদন ছাড়াই। এই স্থানেও প্রতি বর্গফুটের বাজারমূল্য ছিল ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকা। অথচ বিক্রি হয় মাত্র ২২০০ টাকা দরে।
নিয়ম ভঙ্গ করে ক্ষমতায় থাকা, ঋণ খেলাপি অবস্থায় চেয়ারম্যান
দুদকে দায়ের করা অভিযোগে আরও বলা হয়, আব্দুল আলীম ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি নিজেই ব্যাংকের ঋণ খেলাপি, এমনকি এ কারণে কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি দীর্ঘদিন ধরে সমবায় অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে ‘পকেট কমিটি’ গঠন করে একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে আসেন।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের পাহাড়
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, আব্দুল আলীম এই ব্যাংক লুটপাট করে ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, গাজীপুরে মার্কেট, জমি এবং অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন, যা তার ঘোষিত আয় ও সম্পদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তার ও পরিবারের সদস্যদের জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে অনুসন্ধান চালালে এসব প্রমাণ সহজেই পাওয়া যাবে বলে অভিযোগকারীর দাবি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র
সমবায় অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলোতে এই দুর্নীতির একের পর এক চিত্র উঠে এসেছে। ফ্লোর বিক্রি, জমি হস্তান্তর, মূল্য নির্ধারণে কারসাজি এবং অনুমোদনহীন সম্পদ হস্তান্তরের বিস্তারিত বিবরণ সেখানে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
গণতন্ত্রবিহীন ব্যবস্থাপনা, সদস্যদের বঞ্চনা
ঢাকা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের মোট সদস্য সমিতি সংখ্যা ৪০৫টি হলেও কোনো সদস্য সমিতিই কার্যত ভোটাধিকার বা প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায় না। ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয় আওয়ামীপন্থী সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর মাধ্যমে। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ২০১২ সালের প্রজ্ঞাপন অনুসারে যে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির আগে মন্ত্রণালয় ও নিবন্ধকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক হলেও তা লঙ্ঘন করে চলছে সম্পদ বিক্রির খেলা।
বিশাল স্থাবর সম্পদের মালিকানা
ব্যাংকের নামে ঢাকা ও গাজীপুরে রয়েছে প্রায় ৩.৪৫ একর জমি। এর মধ্যে ঢাকার ইসলামপুরেই দুটি বহুতল ভবন রয়েছে—যার একটিতে ব্যাংকের কার্যালয় এবং অন্যান্য ফ্লোর ভাড়ায় দেওয়া হয়। কিন্তু এসব আয় কোথায় যায়, তা স্পষ্ট নয়।
অভিযোগের বিষয়ে সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আলিমের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন