সূচিশিল্পী আমিনুল ইসলাম, সূঁচ ও সুতোয় এঁকেছেন জীবনের সৌন্দর্য

By বিশেষ প্রতিনিধি :

8 Min Read
সূচিশিল্পী আমিনুল ইসলাম, ছবি - নিউজনেক্সট।

ঝিনাইদহের শৈলকুপার লক্ষ্মণদিয়া গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা আমিনুল ইসলাম আজ শুধু একজন আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত সূচিশিল্পী নন, তিনি বাংলাদেশের লোকশিল্প ও পরিবেশ প্রেমের এক অনন্য প্রতীক। জীবনের শুরুতে সমাজের বিদ্রূপ, বাধা, এবং অবজ্ঞার দেয়াল পেরিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘বাংলা সেলাই’ নামের এক স্বকীয় ব্র্যান্ড; সংরক্ষণ করছেন হারিয়ে যেতে বসা নকশিকাঁথার ঐতিহ্য এবং নিজ গ্রামের বাড়িকে রূপ দিয়েছেন এক অনন্য বৃক্ষসংগ্রহশালায়, যেটি এখন পরিচিত ‘গাছবাড়ি’ নামে।

বাল্যকাল থেকেই সূচিশিল্পের প্রতি আমিনুলের ঝোঁক তৈরি হয় তার মাকে দেখে। অবসরে মা যখন কাঁথা, চাদর, রুমাল কিংবা টেবিল ক্লথে সূচিকর্ম করতেন, তখন ছোট্ট আমিনুল মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই কাজ দেখতেন। অন্য শিশুরা যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকত, তখন তিনি সুঁই-সুতোর কাজের জগতে ডুবে থাকতেন। মায়ের হাতের রঙিন নকশা তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। ধীরে ধীরে তিনি নিজেও হাতে তুলে নেন সুই-সুতা, রুমাল কিংবা চাদরে নিজের মতো করে ফোঁড় দিতে শুরু করেন।

কিন্তু পল্লী সমাজ তখন ছেলেদের সূচিকর্মকে সহজভাবে নেয়নি। এই কাজকে একান্তই ‘মেয়েদের জন্য’ বিবেচনা করা হতো। ফলে ছেলেবেলায় আমিনুলকে শুনতে হয়েছে অবিরাম বিদ্রূপ ও কটূক্তি প্রতিবেশী থেকে আত্মীয়, এমনকি নিকটজনের দিক থেকেও আসত অনুশোচনা ও অবজ্ঞা। এসব সামাজিক মানসিক নির্যাতনে তিনি একসময় ভেঙে পড়েন, এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভাবেন। তখন নিজের ভেতরে প্রতিজ্ঞা করেন, সূচিকর্ম আর করবেন না।

তবুও একজন শিল্পীর মন কোনো দেয়ালের কাছে হার মানে না। আমিনুলের শিল্পীসত্তা, যা জন্ম নিয়েছিল মায়ের ভালোবাসা ও স্নেহের ছোঁয়ায়, তা তাকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে সূচিশিল্পের কাছে। সমাজের বাধাকে তোয়াক্কা না করে আবার তিনি ফিরে যান সেই ফোঁড়ের কাজে নকশার জগতে, রঙিন সুতোয় বোনা গল্পের জগতে।

এই সংগ্রামের মধ্যেই গড়ে ওঠে তার শিল্পচর্চার ভিত। মায়ের স্নেহ, শিল্পে ভালোবাসা, আর অন্তর্গত দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে গড়ে ওঠে একজন ব্যতিক্রমধর্মী শিল্পী, যার সূচিকর্মে প্রতিফলিত হয় গ্রামের জীবনের ছবি, মাটির গন্ধ, ফুল-পাখি, নদী ও ঋতুর চিত্র।

আজ সেই ছোট্ট আমিনুলই একজন স্বীকৃত শিল্পী, যার কাঁথার নকশায় বিশ্ব চিনেছে বাংলার ঐতিহ্যকে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তার কাজ আজ আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত। তবুও তার হৃদয়ে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি রয়ে গেছে নিজের শিল্পীসত্তাকে বিসর্জন না দিয়ে, সমাজের চাপকে জয় করে নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার আত্মতৃপ্তি।

আমিনুল ইসলাম, ছবি - নিউজনেক্সট।
আমিনুল ইসলাম, ছবি – নিউজনেক্সট।

আজ আমিনুল ইসলাম শুধু একজন সূচিশিল্পী নন, তিনি বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তার সূচিকর্ম জীবনের সেই প্রাথমিক অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় একটি মায়ের মমতা ও অনুপ্রেরণা, সমাজের বিরুদ্ধে একজন শিল্পীর একাগ্রতা, আর হার না মানা মনোভাব কিভাবে রচনা করতে পারে এক অনন্য ইতিহাস।

আমিনুল ইসলাম বলেন,

    নকশিকাঁথা থেকে বড় কোনো আর্থিক লাভ হয় না আমার। তবে তাতে আমি হতাশ নই। কারণ আমার লক্ষ্য কখনোই শুধু ব্যবসা ছিল না বরং ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখাই আমার আসল উদ্দেশ্য। তিনি আরও বলেন, আমি চাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জানুক, ভালোবাসুক এবং সংরক্ষণ করুক। যাতে করে আমাদের সংস্কৃতি কখনো হারিয়ে না যায়।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমিনুল ইসলাম জানান, ১৯৯০ সালে ঢাকায় এসে তিনি নকশিকাঁথার হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার সংকল্প নেন। শুরু করেন হাতে গোনা কয়েকজন নারী কর্মী নিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে তার কারখানার পরিসর বাড়তে থাকে। আমিনুল ইসলামের সূচিশিল্প ও গাছসংরক্ষণ কার্যক্রম বর্তমানে শুধু তার নিজস্ব শিল্পভবনেই সীমাবদ্ধ নয় তার উদ্যোগ আজ একটি বৃহৎ সামাজিক কর্মযজ্ঞে রূপ নিয়েছে। ঢাকায় অবস্থিত তার কারখানার পাশাপাশি ঝিনাইদহের শৈলকুপার লক্ষ্মণদিয়া গ্রামে গড়ে তোলা ‘গাছবাড়ি’ এবং ‘আক্তার বানু সেলাই কেন্দ্র’ মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার কাজের সঙ্গে যুক্ত।

- Advertisement -
এই বিশাল কর্মপরিসরে কারও ভূমিকা ডিজাইনের কাজে, কেউ সেলাইয়ে, কেউ বাণিজ্যিক বিতরণ বা বিপণনে, আবার কেউ জড়িত গাছের পরিচর্যা বা সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায়। বিশেষ করে অনেক গ্রামীণ নারী এ কেন্দ্রের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছেন।

এভাবে আমিনুল ইসলামের সূচিশিল্প শুধু নান্দনিকতার নিদর্শন নয়, বরং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের এক শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তার এই কর্মযজ্ঞ প্রমাণ করে একজন মানুষের শিল্পচর্চা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নিষ্ঠা কীভাবে শত শত মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

তিনি মূলত তৈরি করেন রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী ‘সুজনী’ ও ‘লহরী’ নকশিকাঁথা। লহরী শব্দটি এসেছে পারস্যের ‘লহর’ থেকে, যার অর্থ ঢেউ। লহরী কাঁথার সেলাই ঢেউয়ের মতো দেখায়, যা সেলাই করা কঠিন এবং দক্ষ কারিগর ছাড়া সম্ভব নয়। প্রতিটি কাঁথা বানাতে সময় লাগে আট মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত। কাজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে কাঁথার ডিজাইন ও পরিকল্পনার সবকিছুতেই থাকে আমিনুলের সরাসরি নির্দেশনা।

‘বাংলা সেলাই’ নামে একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তিনি। এর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বন্ধুদের সংযোগে পণ্য বিক্রি করেন। আড়ংয়ের সঙ্গেও তার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে, ৩০ বছরের বেশি ধরে আড়ংয়ের প্রডিউসার হিসেবে হাতের কাজের তৈরি বেড কভার, পর্দা, কুশোন কভার, টেবিল ক্লথ, রানার, সেলোয়ার-কামিজ, শাড়ি, টেপস্ট্রি সাপ্লাই দিয়ে আসছে।

এখন পর্যন্ত তিনি ২৫০ থেকে ৩০০টি নকশিকাঁথা তৈরি করেছেন, যার মধ্যে বড় নকশিকাঁথার দাম পড়ে ২৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত, ছোট কাঁথা ৮ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়।

- Advertisement -

আর এক ফ্যাশন ডিজাইনার শান্তা কবির বলেন,

    তাঁর নকশিকাঁথার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার সৃষ্টির স্বতন্ত্রতা। প্রতিটি কাঁথায় তিনি তুলে ধরেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের অনুষঙ্গ ফুল, পাখি, গাছপালা, নদী, পিঠার নকশা যা একত্রে প্রকাশ করে দেশীয় সংস্কৃতির আদিম সৌন্দর্য ও আবেগ। তিনি আরও বলেন, আমিনুল ভাই মূলত পুরোনো দিনের মোটিফ নিয়েই কাজ করে। নকশিকাঁথার যে ঐতিহ্যবাহী রূপ, সেটিকেই ধরে রাখতে চায়।

শুধু সূচিকর্ম নয়, প্রকৃতিপ্রেমী আমিনুল ইসলাম গড়েছেন ব্যতিক্রমধর্মী একটি গাছের সংগ্রহশালা ঝিনাইদহের লক্ষ্মণদিয়ায় তার নিজ গ্রামে ‘গাছবাড়ি’ নামে পরিচিত এই প্রকল্প বিস্তৃত ১৪ বিঘা জমির ওপর। যেখানে আছে পাঁচ শতাধিক প্রজাতির প্রায় ১০ হাজার দেশি-বিদেশি গাছ। বেলজিয়াম, পর্তুগাল, মালয়েশিয়া, ভারতসহ নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা দুর্লভ গাছের সমাবেশ ঘটিয়েছেন এখানে। রয়েছে রাজঅশোক, নাগলিঙ্গম, কানাইডাঙ্গা, সরস্বতীচাপা, ঈশের মূল, কুমারীলতা প্রভৃতি গাছ। গাছগুলোতে বাসা বেঁধেছে নানা প্রজাতির পাখি। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই উদ্যান এখন একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত।

আমিনুল ইসলাম জানান, বাবার দেয়া জমির সঙ্গে সংযুক্ত করে আশপাশ থেকে আরও জমি কিনে ১৪ বিঘা জায়গা জুড়ে গড়ে তুলেছেন এই বৃক্ষবাগান। দেশ-বিদেশ ঘুরে সংগ্রহ করেছেন নানা জাতের গাছ।

গাছবাড়িতে আমিনুল ইসলাম, ছবি - নিউজনেক্সট
গাছবাড়িতে আমিনুল ইসলাম, ছবি – নিউজনেক্সট।

তার ভাষায়, গাছ মানেই পাখি। গাছ থাকলে পাখিও ফিরে আসে। তাই তিনি এমন সব গাছ রোপণ করেছেন, যেখানে পাখিরা নিরাপদে বাসা বাঁধতে পারে এবং খাওয়ার মতো ফলও পায়। অনেক গাছে ইতোমধ্যে পাখির বাসা হয়েছে, বাড়িটি হয়ে উঠেছে তাদের এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

প্রতিসপ্তাহেই গাছ ও পাখির টানে আমিনুল ছুটে যান নিজের গ্রামে। গাছগুলোর পরিচর্যা করেন নিজ হাতে। বাড়ির পাশে রয়েছে একাধিক পুকুর, যেখানে মাছ চাষও করেন তিনি। প্রকৃতি, শিল্প ও প্রাণের এমন সমন্বয় দেশের আর কোথাও খুব বেশি দেখা যায় না।

‘আক্তার বানু সেলাই কেন্দ্র’ নামে একটি সূচিশিল্প প্রকল্পও গড়ে তুলেছেন মায়ের নামে, যেখানে গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, আগামী প্রজন্ম যাতে বাংলাদেশের শিল্প-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, সেই লক্ষ্যেই তার প্রচেষ্টা। তার মতে, ‘সবাই মিলে সচেতন হলে আমাদের ঐতিহ্য ও কারুশিল্প বিশ্বমানের জায়গায় পৌঁছাতে পারবে।’

নিজ হাতে গড়া শিল্প ও গাছের সাম্রাজ্য নিয়ে আমিনুল ইসলামের জীবনচিত্র যেন একটিই কথা বলে প্রেম, প্রতিবন্ধকতা আর প্রেরণায় গড়া এক দৃষ্টান্ত।

উল্লেখ্য, আমিনুল ইসলামের তৈরি ‘ময়ূরপঙ্খী’ নকশিকাঁথা ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিল আয়োজিত ‘অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স ফর হ্যান্ডিক্রাফটস-২০২৪’ পুরস্কার অর্জন করে। ঢাকার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে এক অনাড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে ইউনেস্কোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. সুজান ভিজ তাঁর হাতে সম্মাননা তুলে দেন।

newsnextbd20
Share This Article
Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *