১৪ মে ৮৯ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে আলবের্তো মুজিকা কর্ডানো—যিনি বিশ্বজুড়ে ‘পেপে’ মুজিকা নামে পরিচিত। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারালাম এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে, যিনি প্রথাবিরুদ্ধ জীবনাচার, অদম্য রাজনৈতিক সাহসিকতা ও মানবিক দর্শনের কারণে ‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ নামে সম্মানিত হয়েছিলেন।
১৯৩৫ সালের ২০মে উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে জন্মেছিলেন পেপে মুজিকা। তরুণ বয়সেই তিনি কৃষিকাজে যুক্ত হন, কিন্তু দ্রুতই রাষ্ট্রের অন্যায়, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। ষাটের দশকে তিনি সামরিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইরত বামপন্থি গেরিলা সংগঠন ‘টুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট’–এর (MLN-T) প্রধান নেতাদের একজন হয়ে ওঠেন। এই গেরিলা সংগঠন কিউবান বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এ সময় তাঁকে চারবার গ্রেপ্তার করা হয়, ছয়বার গুলিবিদ্ধ হন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর কারাবন্দি জীবন পার করেন।
বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে একাকী অন্ধকার কারাকক্ষে আটকে রাখা হয়, যা তাঁর মানসিক শক্তি ও দর্শনের গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন,
মানুষ তখনই বোঝে, কীভাবে এক ফোঁটা জল কিংবা একটা পোকাও জীবনের অংশ হয়ে যায়।
১৯৮৫ সালে উরুগুয়েতে গণতন্ত্র ফিরে আসার পর তিনি মুক্তি পান এবং মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন।
বামপন্থী রাজনৈতিক জোট ‘ফ্রেন্টে অ্যামপ্লিও’-তে যোগ দিয়ে তিনি ক্রমে হয়ে ওঠেন জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় এক মুখ। ২০০১ সালে সিনেটর হন, ২০০৫ সালে কৃষিমন্ত্রী এবং ২০০৯ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনি বসবাস করতেন নিজের গ্রামীণ খামারের এক সাধারণ ঘরে, তার স্ত্রী ও তিন পা-ওয়ালা একটি কুকুরের সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট ভবনে যাননি, নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে বেশি নির্ভর করতেন নিজের ট্র্যাক্টর ও ভক্সওয়াগন বিটল গাড়ির উপর। মাসিক বেতনের ৯০ শতাংশ দান করতেন দুঃস্থদের জন্য। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে ছিল একটি পুরোনো গাড়ি ও কিছু কৃষিজমি।
এই জীবনযাপন নিয়ে তিনি বলতেন, “আমি দরিদ্র নই। দরিদ্র তারা, যারা ভোগবাদে বন্দী। আমি যা চাই, তা আমার কাছে আছে।” এই বাক্যেই যেন ধরা পড়ে তাঁর জীবনদর্শন।
তাঁর শাসনামলে উরুগুয়ে প্রগতিশীল আইন ও সংস্কারের পথ বেয়ে এগোয়—গাঁজার বৈধতা, সমকামী বিয়ে ও নারীদের গর্ভপাতের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে সামাজিক বৈষম্য হ্রাসের চেষ্টা করেন তিনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও অনড়।
তিনি ছিলেন এক দার্শনিকপ্রবণ নেতাও, যাঁর বক্তব্য জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত মানুষকে আলোড়িত করেছে। একবার তিনি বলেছিলেন,
আমরা উন্নয়নের নামে এমন এক বিশ্ব বানিয়েছি, যেখানে সুখ মানে নতুন গাড়ি, মোবাইল আর দ্রব্যসামগ্রী। কিন্তু সময় কোথায় ভালোবাসা, পরিবার কিংবা প্রকৃতির জন্য?
২০২১ সালে মুজিকার খাদ্যনালিতে ক্যানসার ধরা পড়ে। ২০২৫ সালের মে মাসের শুরুতে তাঁকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে নেওয়া হয়। ১৪ মে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় খামারেই সমাহিত করা হয়, যেখানে তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পোষা কুকুরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে।
তাঁর মৃত্যুতে উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি বলেন, “তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের অন্তর্ধান।” বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস স্মরণ করেন তাঁর প্রজ্ঞা ও জীবনদর্শনকে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেন, “মুজিকা একটি উন্নত বিশ্বের জন্য বেঁচে ছিলেন।”
তাঁর জীবন লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য অনুপ্রেরণা—যেখানে একজন গেরিলা যোদ্ধা রাষ্ট্রপতি হয়ে উঠেছেন, কিন্তু থেকে গেছেন সেই বিপ্লবী হৃদয়ের মানুষটিই।
পেপে মুজিকা আজ নেই, কিন্তু তাঁর জীবন ও দর্শন হয়ে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। তিনি রাজনীতি করেছেন মানুষের জন্য, ক্ষমতায় থেকেও থেকেছেন জনগণের কাতারে।
তিনি ছিলেন এক জীবন্ত চেতনা—নেতৃত্বের, ত্যাগের, আর ভালোবাসার প্রতীক।
আপনার মতামত লিখুন