গ্যাস খাতে অপচয় বেড়েই চলেছে, অনুসন্ধানে জোর দিচ্ছে সরকার

বাংলাদেশের গ্যাস খাতে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে, যার বড় অংশই ‘সিস্টেম লস’ নামে পরিচিত গ্যাস চুরি ও কারিগরি ত্রুটির কারণে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে জোর দিচ্ছে পেট্রোবাংলা
২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে গড়ে ৬.২৮ শতাংশ গ্যাস অপচয় হয়েছে, যা সরকারের নির্ধারিত ২ শতাংশ ‘গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস’-এর অনেক বেশি। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত এই অপচয়ের হার আরও বেড়ে ৭.৪৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যার ফলে ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্যাস সঞ্চালন লাইনে আরও ২ শতাংশ অপচয় রেকর্ড করা হয়েছে।
এই চিত্র তুলে ধরা হয় মঙ্গলবার রাজধানীর কাওরান বাজারে পেট্রোসেন্টারে আয়োজিত দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারে। আয়োজক ছিল বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।
গ্যাস চুরি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা দায়ী
সেমিনারে জানানো হয়, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে কিছু কারিগরি ক্ষতি ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে ধরা হয়, যা ২ শতাংশের মধ্যে থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে এই অপচয়ের হার অনেক বেশি। পেট্রোবাংলার ভাষ্য অনুযায়ী, পুরোনো পাইপলাইন, গ্যাস রাইজারে লিকেজ, উন্নয়নকাজে পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং প্রচুর অবৈধ সংযোগের কারণেই এই অপচয়।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মূল প্রবন্ধে বলেন, বর্তমানে দেশের গ্যাস উৎপাদন ১৫ বছর আগের স্তরে ফিরে গেছে। অনুসন্ধান কার্যক্রমে গতি না আনার কারণে আজ সংকট তৈরি হয়েছে।
তিনি গ্যাস চুরি ও অতিরিক্ত সিস্টেম লস বন্ধে জোর তদারকি এবং গভীর সমুদ্র ও স্থলভাগে নতুন অনুসন্ধানের ওপর জোর দেন।
অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, গ্যাস চুরি ও সিস্টেম লস রোধে ছয়টি বিতরণ সংস্থা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। পাশাপাশি প্রিপেইড মিটার, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, এবং উন্নত মিটারিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, গ্যাস অনুসন্ধানে ৫০ কূপ ও ১০০ কূপ খননের দুটি প্রকল্প জোরদার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ কূপ প্রকল্পে ১৮টির কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং নতুন করে প্রতিদিন ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ১০০ কূপ প্রকল্পের আওতায় দৈনিক প্রায় ৯৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হবে।
এলএনজি আমদানির বিকল্প খুঁজছে সরকার
রেজানুর রহমান জানান, শীতকালে এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমান কম দামে কিনে মজুদ করার সুযোগ কাজে লাগাতে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ বছর সময় লাগতে পারে।
শিল্পে গ্যাস সংযোগে প্রাধান্য
তিনি বলেন, শিল্পখাতকে গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ নিরুৎসাহিত করার নীতিও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১০ মেগাওয়াটের বেশি প্রকল্পে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না।
আগামী পদক্ষেপ
সেমিনারে আরও জানানো হয়, কূপ খননে গতি আনতে দুইটি নতুন রিগ কেনা হচ্ছে। একটি রিগ ক্রয়ের প্রস্তাব একনেক সভায় তোলা হবে, অন্যটির সমীক্ষা চলছে। এছাড়া, ডিসেম্বরের মধ্যে ভোলা জেলার পূর্ণাঙ্গ সিসমিক জরিপ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০০ কূপ প্রকল্পের আওতায় ১৯টি কূপকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হলে দৈনিক ২৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে একদিকে গ্যাসের অপচয় ও চুরি রোধ, অন্যদিকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে সংকট অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।
আপনার মতামত লিখুন