তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, স্মরণে গৌতম চট্টোপাধ্যায়

মনিরুল ইসলাম :
প্রকাশ: ৩১ মে, ২০২৫, ৭:৩৬
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, স্মরণে গৌতম চট্টোপাধ্যায়

গৌতম চট্টোপাধ্যায়, ছবি - ইন্টারনেট থেকে।

১ জুন। বাংলা গানের ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট তারিখ। এই দিনে জন্মেছিলেন সেই মানুষটি, যিনি বাংলা গানে এনেছিলেন প্রতিবাদের ভাষা, চেতনার ঝড়, আর বিকল্প সংগীতধারার জোয়ার। তিনি গৌতম চট্টোপাধ্যায়—”মহীনের ঘোড়াগুলি” ব্যান্ডের প্রাণপুরুষ, যিনি শুধু গায়ক বা গীতিকার নন, ছিলেন এক রাজনৈতিক চেতনার ধারক, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অন্যতম মুখ।

‘ভালোবাসি জোৎস্নায়’, ‘চৈত্রের কাফন’, ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ কিংবা ‘আশায় আশায় বসে আছি ওরে আমার মন’—এমন অজস্র গান দিয়ে দশকের পর দশক ধরে সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে কলকাতার কিংবদন্তি ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। গত শতকের সত্তর দশকে এই ব্যান্ডটি গড়ে তোলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। শুধু গঠনই নয়, ব্যান্ডটির মূল চালক, ভাবনার নাবিক ও স্রষ্টাও ছিলেন তিনি। আজ সেই গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন।

১৯৭৫ সালের এক সন্ধ্যায়, দক্ষিণ কলকাতার কোনও এক অচেনা ছাদে দাঁড়িয়ে কয়েকজন তরুণ বলছিল, “আমরা এমন এক ব্যান্ড গড়ব, যেটা শুধু গান করবে না, কথা বলবে। প্রতিবাদ করবে, ভালোবাসবে, স্বপ্ন দেখাবে।” তাঁদের মধ্যে যিনি ছিলেন প্রাণভোমরা, তাঁর নাম গৌতম চট্টোপাধ্যায়। সেদিন থেকে শুরু হল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র পথচলা—যা একদিন হয়ে উঠবে বাংলা গানের সবচেয়ে র‍্যাডিকাল রাজনৈতিক অভিব্যক্তির প্রতীক।

গৌতম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মূলত বিদ্রোহের আর ভালোবাসার কণ্ঠস্বর। তিনি যেমন গভীরভাবে সংগীতসচেতন ছিলেন, তেমনই ছিলেন সমাজসচেতন এক বোহেমিয়ান। ক্লাসিক্যাল ও পশ্চিমি সুরের মেলবন্ধনে তৈরি করলেন এক নতুন ধারার বাংলা গান, যাকে এক কথায় বলা যায়—”সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ”। তাঁর লেখনীতে, সুরে, এবং কণ্ঠে যে বিদ্রোহ ছিল, তা ছিল শহরের অন্ধকার গলির গল্প, শ্রমিকের ক্লান্তি, বস্তির স্বপ্নভাঙা বাস্তব, প্রেমে চূর্ণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস—সব মিলিয়ে এক শহুরে কবিতার ডকুমেন্টারি।

১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিওলজি পড়তেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। বন্ধু সমরেশ চৌধুরীর লেখায় জানা যায়, তিনি ছিলেন আড্ডার প্রাণ, মজার মানুষ। তখন উত্তাল নকশাল আন্দোলন। গৌতম স্প্যানিশ গিটার শিখেছেন বিদ্যুৎবাবুর কাছে, গড়েছিলেন এক ব্যান্ড, গাইতেন পার্কস্ট্রিটের বারে বিটলস বা সাইমন-গারফাংকেলের গান। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলে গেলেন তিনিও—হিপি রূপ ছেড়ে পরলেন খদ্দরের পাঞ্জাবি, পাে ফেললেন বিপ্লবের পথে।

রাতভর বাইরে থাকতেন, কখনো সপ্তাহখানেকও বাড়ি ফিরতেন না। একদিন সিআরপি হানা দিল বাড়িতে, মা–বাবার দিকে বন্দুক তাক করা, বাড়ি তছনছ। গৌতম তখন গা ঢাকা দিয়েছেন, ফিরলেন কয়েক সপ্তাহ পর দেহে আঘাত, মুখে দাড়ি, ব্লাড ডিসেন্ট্রিতে জর্জরিত। জানান, সুন্দরবনে পার্টির কাজে ছিলেন। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন অনেকেই বলছিলেন, তিনি জেলে সেফ, বাইরে ফেক এনকাউন্টারে মারা পড়বেন।

দমদম জেলে তখন সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন তাঁর কলেজের পুরনো সহপাঠী অনিন্দ্য মুখার্জি। তিনি গৌতমের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, জেলে গিটার বাজানোর অনুমতিও পাইয়ে দেন। যখন মুক্তির আদেশ আসে, অনিন্দ্যই বলেন তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠাতে হবে। এরপর গৌতমকে গোপনে জব্বলপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠানো হয়। এভাবেই শুরু হয় তাঁর নতুন জীবন।

তাঁর গানে কোনো প্রথাগত ‘রোমান্টিক’ প্রেম ছিল না। বরং প্রেমের মধ্যে ছিল আদর্শ, রাজনীতি, ছিন্নমূলতার বেদনা, শহরের প্রতি দায়বদ্ধতা। ‘ভবিষ্যতের গান’ কিংবা ‘রাতের ট্রেন’ এসব গানে উঠে এসেছে সমাজের পরোক্ষ রাজনীতি, ক্ষমতার সমালোচনা, আর মানুষের নিজের সঙ্গে নিজস্ব লড়াই। তিনি গানকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং একটি সামাজিক অস্ত্র করে তুলেছিলেন।

সত্তরের উত্তাল সময়ে যখন নকশাল আন্দোলনের প্রতিধ্বনি শহর-গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন গৌতম ছিলেন সেই বিপ্লবী কণ্ঠগুলির এক অনন্য প্রতিভূ। তিনি নিজে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর গান, কবিতা, এবং ভাবনায় রাজনৈতিক চেতনার গভীর ছায়া পড়েছে। অনেকেই বলেন, “গৌতম ছিলেন বামপন্থী না হয়েও সবচেয়ে বামপন্থী শিল্পী”।

‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে, তখন তা জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু গৌতম হাল ছাড়েননি। ব্যর্থতাকে শক্তি করে তিনি পথ চলেছেন। দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে ফিরে এসে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করেছেন, ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ গানে যেমন নতুন উদ্যমে ফিরিয়ে এনেছেন সেই পুরনো স্বপ্ন।

গৌতম কখনো মূলধারার গানে হাঁটেননি। তাই প্রচলিত গণমাধ্যমে তাঁকে খুব বেশি দেখা যায়নি। তাঁর গানকে বলা হয়েছিল “অপরিচিত”। এক সময়কার ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ হয়তো জনসাধারণের মধ্যে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, কিন্তু তাদের গানগুলি বেঁচে থাকে গোপনে, ক্যাসেটের হাত বদলে, ছাত্র-আন্দোলনের ভেতরে, বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনের উৎসবে।

তাঁর সৃষ্টিকর্মে ছিলেন না রোমান্টিক সৌন্দর্য বা বিনোদনের চটকদার ভঙ্গি। বরং ছিল ঘাম, ধুলো, শহুরে নিঃসঙ্গতা, শ্রমজীবী মানুষের কথকতা। সেই কারণেই তিনি ছিলেন বিকল্প ধারার, স্বাধীন চেতনার এক অনন্য প্রতিভা।

‘ তাঁরারাও যত আলোক বর্ষ দূরে’ এই একটি পংক্তি যেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্বকেই প্রতিফলিত করে। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই তারার মতো দূরে, আলো ছড়ানো এক আলাদা মহাকাশের বাসিন্দা, যাঁর সৃষ্টিশীলতা, গভীরতা আর দৃষ্টিভঙ্গি আজও বহু আলোকবর্ষ এগিয়ে। তাঁর গান ছিল শহরের দেয়ালে লেখা রাজনৈতিক পোস্টারের মতন—কখনো রুক্ষ, কখনো কাব্যিক, সবসময় তীক্ষ্ণ।

বাংলাদেশেও গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর ব্যান্ডের গান ছাত্ররাজনীতি, মুক্ত চিন্তা ও বাম ধারার সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল। বাংলাদেশে বিকল্প সংগীত আন্দোলনের (আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড কালচার) অগ্রপথিকদের অনেকেই গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে তাঁদের ‘প্রথম গুরু’ বলে মনে করেন। তিনি হয়ে ওঠেন সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের একটি চরিত্র, যিনি সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকেন।

গান ছাড়াও গৌতম ছিলেন চিত্রপরিচালক, নাট্যকার ও লেখক। তিনি বানিয়েছেন তথ্যচিত্র, শর্টফিল্ম এবং নাটক। তাঁর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘ত্রিবেণী’ এবং অন্যান্য কাজ পশ্চিমবঙ্গে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আন্তঃশিল্প—গান, নাটক, চিত্রকলা এবং রাজনীতি, সব কিছু মিশে তৈরি হয়েছিল এক অভিন্ন গৌতম-চেতনা।

গৌতম চট্টোপাধ্যায় কেবল এক সংগীতশিল্পী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক প্রতিরোধের প্রতীক, এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবী, যিনি নির্জনতা ও শহুরে ক্লান্তির মাঝেও জ্বালিয়ে গেছেন আলো।

নবারুণ ভট্টাচার্য ঠিকই বলেছিলেন, “রেবেলদের ভাগ্য দুঃখেরই হয়। স্পার্টাকাস থেকে চে গুয়েভারা, দেখতে দেখতে মনের চোখের সয়ে যাওয়ারই কথা। গৌতম তাঁদেরই একজন—ট্র্যাজিক এবং বিজয়ী।” এই একটি বাক্যেই যেন ধরা আছে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জীবন ও সংগ্রামের সারকথা।

বিদ্রোহ, স্বপ্ন, সংগীত ও সমাজ বদলের অদম্য আকাঙ্ক্ষায় যাঁর জীবন একান্তই তাঁর নিজের তৈরি এক মহাকাব্য।