নাকিব হাসান তরফদার: আমলতন্ত্রে যার উত্থান রূপকথার মতন

বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রকাশ: ২৮ মে, ২০২৫, ৯:৫৭
নাকিব হাসান তরফদার: আমলতন্ত্রে যার উত্থান রূপকথার মতন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাকিব হাসান তরফদার, ছবি - সংগৃহীত।

বাংলাদেশের প্রশাসনিক জগতে এমন কিছু নাম আছে যাদের উত্থান বিস্ময় জাগায়, প্রশ্ন তোলে, আবার অনুপ্রেরণাও দেয়। তেমনি এক ব্যতিক্রমী নাম নাকিব হসান তরফদার। যাকে ঘিরে কেবল সফলতার গল্প নয়, বরং ঘোরতর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতার বলয়, আর ‘সিস্টেমের আশীর্বাদ’ নিয়ে নানান প্রশ্ন ঘোরে।

ছোট শহরের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে সচিবালয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসা নাকিব হাসানের  এই যাত্রা অনেকের কাছেই রূপকথার মতন শোনালেও, যারা প্রশাসন ঘনিষ্ঠ, তাদের কাছে এর পেছনের গল্প অনেক জটিল, অনেক প্রশ্নবিদ্ধ।

৩০তম বিসিএস ক্যাডার, একসময়কার ছাত্রলীগ নেতা, তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে দলের হয়ে কাজ করেছেন প্রাণপণে। তাঁর সেই দলীয় আনুগত্যের পুরস্কারও মিলেছে দফায় দফায়, এসিল্যান্ড থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ জেলা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব, সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদায়ন, পরে বঙ্গভবনে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কার্যালয়ে।

এরপরই তিনি জায়গা করে নেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে। প্রথমে মাহমুদ আলী সভাপতিত্বাধীন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন, পরে অর্থমন্ত্রীর অফিসেই রয়ে যান ছায়াসঙ্গী হিসেবে।

নাকিব হাসান তরফদারের ক্যারিয়ারের আরেকটি ব্যতিক্রমী অধ্যায় ছিল একজন সিনিয়র সহকারী সচিব হয়েও হঠাৎ করে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া। প্রশাসনে এমন নজির নেই বললেই চলে—যেখানে একজন কর্মকর্তা মূল প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে সরে এসে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে পড়েন।

এই পদায়ন নিয়ে তৎকালীন সময়েই সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে গুঞ্জন ও সমালোচনা শুরু হয়। অনেকেই একে প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে দেখেন। অভ্যন্তরীণ নথিপত্র বিশ্লেষণেও বোঝা যায়, এ পদায়নের পেছনে ‘বিশেষ অনুমোদন’ ও ‘আপৎকালীন প্রয়োজন’ দেখিয়ে ফাইল তড়িঘড়ি করে নিষ্পত্তি করা হয়, বলে প্রশাসনের অনেকেই মনে পরে।

এমন এক পদক্ষেপে কেবল প্রশাসনিক শৃঙ্খলাই প্রশ্নের মুখে পড়ে না, বরং তা আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়েও বড় প্রশ্ন তোলে।

বিশ্বস্ত দলীয় আমলা হিসেবে তিন বিতর্কিত নির্বাচনে ভূমিকার কারণে নাকিবের প্রতি আওয়ামী সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আস্থা ছিল—এমন মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক একাধিক কর্মকর্তা। তাঁরা জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন নাকিব। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ ধনঞ্জয় কুমার দাসের প্রধান সহকারী হিসেবে কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি।

একটি গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগে অন্তত ১০ জনের নিকট থেকে তিনি ১ কোটি টাকার ঘুষ নিয়েছেন। ওই ১০ জন সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থক, যাদের নিয়োগ নিশ্চিত করেছিলেন নাকিব, বলেও অভিযোগ আছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গড়ে ওঠা দুর্নীতির সিন্ডিকেটের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন মন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব হারুন উর রশিদ বিশ্বাস, জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন এবং তথ্য কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পুলিশের এসপি বদলিতে এক বছরের জন্য দিতে হতো ১ কোটি টাকা, স্থানভেদে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্তও উঠত। এসব লেনদেনের মধ্যস্থতা ও ‘মিডিয়া’ করতেন এপিএস মনির হোসেন ও পিআরও অপু। ঘুষের টাকা ঢাকায় ধানমন্ডির বাসায় মন্ত্রীর ছেলের হাতে রাতের আঁধারে পৌঁছে দিতেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

এভাবে গত এক দশকে পুলিশের এসপি, ওসি ও এসআই পদে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠে এসেছে। পাশাপাশি প্রায় ৫০০ ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে নেয়া হয়েছে শত কোটি টাকা ঘুষ। অস্ত্র লাইসেন্স সংক্রান্ত কার্যক্রম দেখভাল করতেন নাকিব হাসান তরফদার নিজেই।

প্রশাসনের ভেতরে আরেকটি সূত্র জানায়, নাকিবের ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন সাবেক মন্ত্রীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন।

শুধু স্বরাষ্ট্র নয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ে মাত্র ৭ মাস দায়িত্বে থেকেই বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করেন নাকিব ও তাঁর ঘনিষ্ঠ শাহ সালাউদ্দিন। এ সময়ে গণপূর্ত, বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চলমান অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে তারা সুবিধা আদায় করেছেন বলে জানিয়েছেন সিএজি কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এমন একজন বিতর্কিত ও প্রভাবশালী আমলা আওয়ামী সরকারের পতনের পরও প্রশাসন কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হননি। বরং কাকতালীয়ভাবে তাঁকে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলি করা হয়।

জনপ্রশাসন বিশ্লেষক আনোয়ার আজিম চৌধুরী বলেন,

    এটা এক ধরনের ধুর্ততা—যা প্রশাসনের কাঠামোকে দুর্বল করে। দলীয় আনুগত্য আর লবিংয়ের ভিত্তিতে যেভাবে তাঁরা পদ-পদবিতে উঠে এসেছেন, তাঁদের আইনি বা কাঠামোগত জবাবদিহির আওতায় না আনা গেলে আগামীতে কেউই শিক্ষা নেবে না।

যদিও নিজের অস্বাভাবিক ক্যারিয়ার গ্রোথ, প্রশাসনে গড়ে তোলা সিন্ডিকেট এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন নাকিব হসান তরফদার। একাধিকবার তিনি প্রতিবেদককে ফোনে এসব অভিযোগকে “সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন” বলে দাবি করেন। একইসঙ্গে তিনি প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন এবং বলেন, “এতে ভুল বার্তা যাবে, আমার পরিবার, ক্যারিয়ার, সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”