নির্ভীক শহরের নাম তেহরান, প্রতিরোধ যার ঘরে ঘরে

বিশ্ব রাজনীতির এক উত্তাল প্রেক্ষাপটে আবারও দৃঢ় জাতীয় ঐক্যের পরিচয় দিল ইরানের জনগণ। অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন, বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কায় ইরানের জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। তবে বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ইরানের জনগণ ‘ভীত সন্ত্রস্ত’ হওয়ার বদলে রাস্তায় নেমে আসে। ‘মৃত্যু বরং পরাধীনতা নয়’ স্লোগান তুলে ধরে তারা দেশের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য প্রকাশ করে। ইরানে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বহু বছর ধরেই আন্দোলন-প্রতিবাদ চলে আসছে। বিশেষত নারী অধিকার, অর্থনৈতিক দুর্দশা ও ধর্মীয় দমননীতির কারণে দেশটি অভ্যন্তরীণ উত্তেজনায় আক্রান্ত। কিন্তু বাইরের আক্রমণের মুহূর্তে সব বিভাজন ভুলে জনগণ একত্রিত হয়।
ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, ইরানি জাতিসত্তা যতবার হুমকির মুখে পড়েছে, ততবারই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বিমান হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক ও কূটনৈতিক কর্মকর্তারা নিহত হন, যা নিয়ে তেহরান সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৩ এপ্রিল ইরান নজিরবিহীনভাবে শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের অভিমুখে ছুড়ে দেয়, যার বেশিরভাগই প্রতিহত করে ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর জবাবে ১৯ এপ্রিল মধ্যরাতে ইসরায়েল ইরানের ইস্ফাহান প্রদেশে পাল্টা হামলা চালায় বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানান। বিবিসির বরাতে তখন জানা যায়, একটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র ইস্ফাহানে আঘাত হানে। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বিস্ফোরণের কথা জানালেও তা সরাসরি হামলা হিসেবে উল্লেখ করেনি। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে ইস্ফাহানের আকাশে কমলা আলোর ঝলকানি দেখা যায়, যা বিমানবিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ বলেই মনে করা হয়।
ইসরায়েল হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন।
যুক্তরাজ্য, চীন ও মিসরসহ একাধিক দেশ উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানায়। এ সময় আন্তর্জাতিক মহলে ধারণা তৈরি হয় যে, ইরান বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে এবং এর ফলে দেশটির জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন।
দেশজুড়ে জনগণ ভীত হওয়ার বদলে রাস্তায় নেমে আসে। তারা ‘মৃত্যু বরং পরাধীনতা নয়’, ‘আমেরিকার দুঃশাসন চাই না’ ‘ইসরায়েল ধ্বংস হোক’ এমন স্লোগানে মুখর হয়ে জাতীয় পতাকা হাতে দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তরুণ-তরুণীরা সক্রিয় হয়ে উঠে। #StandWithIran, #DeathBeforeSubmission হ্যাশট্যাগে দেশপ্রেমের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই রক্ত দিয়ে পতাকা আঁকার ছবি পোস্ট করে যুদ্ধবিমুখ বিশ্বকে জানান দেয়, ইরান মাথা নত করবে না।
বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ, এমনকি সরকারের সমালোচকরাও বাইরের আক্রমণের সময়ে দেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। এমনকি ইরানে হিজাববিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা সংকট, অর্থনৈতিক মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি ইস্যুতে বহু সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এদের অনেকেই দাবি করে ‘অরাজনৈতিক’। কিন্তু বাইরের হুমকি যখন আসে, তখন তারাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ—আমরা ইরানের সন্তান, রক্ত দিয়ে হলেও দেশ রক্ষা করব।
অভ্যন্তরীণ বিভাজন ভুলে তারা ইরানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কেবল প্রতিরোধ নয়, বরং একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির অস্তিত্ব রক্ষার আহ্বান। ইরানিদের দেশপ্রেম কোনো তাৎক্ষণিক আবেগ নয়; এটি হাজার বছরের ঐতিহ্য, ধর্মীয় চেতনা এবং ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার ধারাবাহিকতা।
ইরানের রাজনৈতিক জনমানসে এখনও বিপ্লবী চিন্তার গভীর ছাপ রয়েছে। হোক তা ধর্মীয় বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ, দুই ধারার মধ্যে একপ্রকার সহাবস্থান গড়ে উঠেছে।
তরুণদের একাংশ নিজেকে ‘ইসলামি-ন্যাশনালিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে, যারা একদিকে ধর্মের প্রতি আনুগত্য দেখায়, অন্যদিকে ইরানকে পরাশক্তির শোষণমুক্ত একটি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। এদের রাজনীতিতে ইসরায়েলবিরোধিতা, ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মিতা, এবং মার্কিন নীতির বিরোধিতা স্পষ্ট।
মার্কিন ড্রোন হামলায় কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের সময়ও ঠিক একই রকম দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। তখনও তারা শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে জাতীয় সংহতির বার্তা দিয়েছিল।
এবারও সেই চেতনার ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইরানজুড়ে বিজয় উৎসব পালিত হয়।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পরপরই ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক মহলে উচ্ছ্বাস দেখা যায়। ইরানের সহরাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ রেজা আরেফ বলেন, এই বিজয়ের মাধ্যমে ইরান কেবল সামরিক নয়, কূটনৈতিক অঙ্গনেও প্রমাণ করেছে, আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির শিং ভেঙে দেওয়ার মতো সক্ষমতা তাদের আছে। এটি ইরানের প্রকৃত শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
ইরানের সংসদের স্পিকার ও প্রাক্তন আইআরজিসি কমান্ডার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফের উপদেষ্টা মাহদি মোহাম্মাদি একে যুগান্তকারী বিজয় বলে মন্তব্য করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক বার্তায় তিনি বলেন, একটি নতুন যুগের সূচনা হলো। ইরানের পারমাণবিক শক্তি অধিদপ্তরের মুখপাত্র বেহরুজ কামালভান্দি বলেন, আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেউ থামাতে পারবে না। এটি বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতির প্রতিফলন, যা আর কোনোদিন থেমে থাকবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি কৌশলগতভাবে ইরানের জন্য একটি সফলতা। এতে সরাসরি সংঘাত থেকে সরে এসে ইরান একটি শক্ত অবস্থান থেকে আলোচনায় বসার সুযোগ পেয়েছে এবং দেশের জনগণের সামনে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা তুলে ধরতে পেরেছে।
ইরানের শহরগুলো বিজয় উদযাপনে মুখর হয়ে ওঠে। রাস্তায় নেমে জনগণ ‘আমেরিকা নিপাত যাক’, ‘ইসরায়েল ধ্বংস হোক’—এমন স্লোগান তোলে। অনেক জায়গায় মিছিল, পতাকা প্রদর্শনী, বিপ্লবী সংগীত এবং ধর্মীয় স্লোগানে মুখর হয় জনজীবন।
তবে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে এই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরান-ইসরায়েল বৈরিতা বহু পুরোনো ও গভীর, ফলে সংঘাত বন্ধ থাকলেও উত্তেজনা থেকেই যাবে। চলতি বছরের ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো। জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা চালায়। সংঘাত চরমে পৌঁছালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বয় করে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। এর জবাবে ইরান কাতার ও ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন এবং উভয় দেশ তা মেনে নেয়।
তেহরান মনে করছে, এই যুদ্ধবিরতি কেবল একটি সাময়িক বিরতি নয়, বরং এটি বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে—তারা ভয় পায় না, বরং সম্মানের জন্য যেকোনো সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জানে।
ইরান বিশ্বাস করে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তারা এখন আরও দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী অবস্থানে দাঁড়িয়ে।
আপনার মতামত লিখুন