বিএসএমএমইউ’র ৩৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত

ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংস হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সাবেক বিএসএমএমইউ’র ৩৪ জন চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুতির চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশে এই সিদ্ধান্তকে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাসে নজিরবিহীন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্ট মহল।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী শান্তিপূর্ণ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক বিএসএমএমইউ) ঘটে ভয়াবহ এক হামলার ঘটনা। কেবিন ব্লকের সামনে এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা, আন্দোলনকারীদের ওপর চিকিৎসক-কর্মচারীদের সংঘবদ্ধ হামলা, মূল্যবান যন্ত্রপাতি লুটপাট এবং ৩০টিরও বেশি গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সে অগ্নিসংযোগ, এসব ঘটনার ভিডিও প্রমাণ সেদিন ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে।
পরে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ৩১ মে ২০২৫ তারিখে এক সভায় ৩৪ জনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি টানা ৩৬টি বৈঠক করে, অভিযুক্তদের লিখিত জবাব, ভিডিও ফুটেজ, নিরাপত্তা প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য-জবানবন্দির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্তে দেখা যায়, হামলায় সরাসরি অংশ নেয় ১৫ জন (‘ক’ ক্যাটাগরি), আর ‘খ’ ক্যাটাগরির ১৯ জন সক্রিয়ভাবে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে অংশ নেন। বাকি চারজনের বিষয়ে তদন্ত এখনো চলমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘ক’ ক্যাটাগরির ১৫ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের ৫(ঘ), ৫(ঝ) ও ৫(ট) ধারা অনুযায়ী, এবং ‘খ’ ক্যাটাগরির ১৯ জনকে ৬(ঠ) ধারা অনুযায়ী স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
তদন্তে উঠে আসে, অভিযুক্তদের বড় একটি অংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ‘স্বাচিপ’-এর সক্রিয় সদস্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনীতির প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে চলা দলীয় নিয়ন্ত্রণ এই সহিংসতার জন্ম দিয়েছে।
চাকরিচ্যুত হচ্ছেন চিকিৎসকসহ যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী :
‘ক’ ক্যাটাগরি (১৫ জন):
প্যালিয়েটিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আবু তোরাব মীম, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ রিয়াদ সিদ্দিকী, পরিচালক (হাসপাতাল) অফিসের পেইন্টার নিতীশ রায় ও মো. সাইফুল ইসলাম, এমএলএসএস মেহেদী কাজী, সহকারী ড্রেসার মো. শহিদুল ইসলাম, সুইপার সন্দীপ দাস, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী উজ্জ্বল মোল্ল্যা, পরিবহন শাখার ড্রাইভার সুজন বিশ্ব শর্মা, ওপিডি-১ এর এমএলএসএস ফকরুল ইসলাম জনি, ল্যাবরেটরি সার্ভিস সেন্টারের কাস্টমার কেয়ার অ্যাটেনডেন্ট রুবেল রানা, ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস শাহাদাত, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স শবনম নূরানী, ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস মো. আনোয়ার হোসেন এবং কার্ডিওলজি বিভাগের এমএলএসএস মো. মুন্না আহমেদ।
‘খ’ ক্যাটাগরি (১৯ জন):
ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারুক হোসেন, নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আহসান হাবিব, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লাহ, নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুভাষ কান্তি দে, অনকোলজি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোহাম্মদ জাহান শামস্, সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নূর-ই-এলাহী, অটোল্যারিংগোলজি- নাক কান গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসানুল হক, শিশু নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে এম তারিকুল ইসলাম, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশীষ কুমার সরকার, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল-মামুন, নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শাহনেওয়াজ বারী, কার্ডিওলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. অমল কুমার ঘোষ, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ।
চারজনের বিষয়ে তদন্ত চলমান:
ডা. জিল্লুর রহমান ভূইয়া, ডা. মনোয়ার হোসেন, ডা. বেলাল হোসেন সরকার ও ডা. মো. আবিদ—তাদের বিষয়ে অধিকতর তদন্তের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এত সংখ্যক চিকিৎসক-কর্মকর্তাকে একযোগে চাকরিচ্যুত করার ঘটনা নজিরবিহীন। প্রশাসনের মতে, এটা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বাস্তবায়ন হলেও শিক্ষার্থীদের অনেকে বলছেন, বহু অপরাধী এখনো বহাল তবিয়তে আছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক প্রক্টর ডা. ফারুক মুন্সি, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. ফরিদ রায়হান এবং সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. আবুল কালাম চৌধুরীর মতো প্রভাবশালী মদদদাতারা শাস্তির আওতায় না আসায় বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করারও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। অর্থাৎ শুধু চাকরিচ্যুত করাই নয়, আইনগত বিচারও চলবে।
আপনার মতামত লিখুন