বিসিবিতে নেতৃত্বের নাটক: ফারুকের পতন, বুলবুলের উত্থান

নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশ: ৩০ মে, ২০২৫, ৫:০৫
বিসিবিতে নেতৃত্বের নাটক: ফারুকের পতন, বুলবুলের উত্থান

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আবারও রাজনৈতিক প্রভাব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রশাসনিক অনিয়মের ঘূর্ণাবর্তে। সাবেক অধিনায়ক ও অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল যখন অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হন, তখন থেকেই ফারুক আহমেদের বিদায় কার্যত সময়ের ব্যাপার ছিল।

ফারুক আহমেদের বিসিবি সভাপতির গদি যে নড়বড়ে হয়ে গেছে, তা অনেক আগেই বোঝা যাচ্ছিল। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তাঁর বিকল্প খুঁজছিল কয়েক মাস ধরে। বিষয়টি চূড়ান্ত হয় যখন বুলবুল স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনকালীন সভাপতির দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। এরপর যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে ফারুককে মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়ে পদত্যাগ করতে বলা হয়।

ফারুক প্রকাশ্যে পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানান এবং অভিযোগ করেন যে তাঁকে “কারণ ছাড়াই” সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আট পরিচালকের দেওয়া তিন পাতার অনাস্থাপত্রে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তা তাঁর অপসারণে যথেষ্ট বলে মনে করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। সেই প্রেক্ষিতে ফারুকের পরিচালক পদ বাতিল করে এনএসসি, যার ফলে সভাপতি পদও অটো বাতিল হয়ে যায়।

ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো নেহায়েত সাধারণ নয়। বিপিএলে অনিয়ম, ক্লাব নিবন্ধনে স্বেচ্ছাচারিতা, বকেয়া ৩২ কোটি টাকা আদায়ে নিষ্ক্রিয়তা, পছন্দের শিল্পগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া, বাছাই লিগ থেকে তৃতীয় বিভাগে উন্নীত হওয়া ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দেওয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থা না নেওয়া, এবং বিতর্কিত ক্লাবগুলোর নিবন্ধন বাতিলের গোপন প্রচেষ্টা ছিল মূল অভিযোগের অংশ। এছাড়া পরিচালকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি, সিনিয়র ক্রিকেট ব্যক্তিত্বদের হেয় করা, এমনকি পরিচালকদের অভিযোগে প্রভাব বিস্তার করে তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করারও অভিযোগ এসেছে।

এনএসসি গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যেহেতু তৃতীয় ক্যাটাগরি থেকে কাউন্সিলর মনোনয়ন ও সেখান থেকে পরিচালক পরিবর্তনের পূর্ণ অধিকার রাখে, তারা সেই আইনি সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফারুককে সরিয়ে দেয়। একই প্রক্রিয়ায় যেভাবে ফারুক আগে পরিচালক ও সভাপতি হন, সেভাবেই আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে এনএসসি কাউন্সিলর করে পরিচালক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

আইসিসিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা আমিনুল ইসলাম বুলবুল এই সংকটময় মুহূর্তে দেশের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। চার মাসের ছুটি নিয়ে তিনি নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কোনো প্রকার নির্বাচনে অংশ নেবেন না, এমনকি পরবর্তীতে বিসিবি কাউন্সিলরও থাকবেন না। শুধুমাত্র একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করেই ফিরে যাবেন তাঁর আন্তর্জাতিক দায়িত্বে।

অন্যদিকে, ফারুক আহমেদ এখনো নিজ অবস্থানে অনড়। তিনি বলেছেন, তাঁকে সরকার নাকি আর রাখতে চাচ্ছে না—এমন কথা বলা হলেও তার কোনো কারণ তাঁকে জানানো হয়নি। তিনি নিজে থেকে সরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না বলেও জানান। এই অনাস্থার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, বিসিবির গঠনতন্ত্রে অনাস্থা প্রস্তাবের কোনো ধারা নেই, তাই পরিচালকদের অনাস্থা সংবিধানগতভাবে অর্থবহ নয়।

ফারুকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এবং পরিচালকদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের ফলে পরিস্থিতি যেদিকে গড়িয়েছে, তাতে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন যে গভীর সংকটে রয়েছে তা স্পষ্ট। বিসিবির নেতৃত্ব পরিবর্তন এই মুহূর্তে কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ফারুককে বসানো হয়েছিল স্বচ্ছতা ফেরানোর আশ্বাস দিয়ে। অথচ দায়িত্ব নেওয়ার নয় মাসের মধ্যে তিনিই নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসন বহুবারই প্রভাবশালী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং ব্যক্তি কেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছে। ফারুক আহমেদের অপসারণ এবং বুলবুলের অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব গ্রহণ তারই সর্বশেষ নজির। এই ঘটনায় বিসিবির গঠনতন্ত্রের দুর্বলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, এবং সরকারের প্রভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া ক্রিকেট প্রশাসনের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যও অত্যন্ত জরুরি।