যুদ্ধের ভয়, অস্ত্রের ব্যবসা: ইরান পারমাণবিক পরীক্ষা করলে কী ঘটবে ?

বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধ অনেক সময় শুধু রক্তপাত নয়, বরং তা হয়ে ওঠে একটি গভীর ব্যবসায়িক কৌশল। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যুদ্ধ যেন এক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, যার ডিভিডেন্ড আসে অস্ত্র বিক্রি, কৌশলগত প্রভাব এবং বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইউরোপে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, তা মার্কিন অস্ত্র শিল্পের জন্য ছিল সোনার খনি। কিন্তু সেই আতঙ্ক এখন অনেকটাই ম্লান। ইউরোপের দেশগুলো যুদ্ধ ক্লান্ত, বাজেট সীমিত, জনমত বিভক্ত। ফলে অস্ত্র বিক্রির সেই বাজার এখন আর আগের মতো সক্রিয় নয়।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র নতুন এক হুমকি তৈরি করতে চায়, যেখানে ইরান পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো মানে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নয়, বরং একটি নতুন অস্ত্র বাজারের দরজা খুলে যাওয়া। ইরান যদি একটি মাত্র পরীক্ষাও করে, তাতেই সৌদি আরব থেকে শুরু করে তুরস্ক, কাতার, মিশর পর্যন্ত সবাই নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে ভুগবে। আর এই আতঙ্কের ফাঁদেই গুটিয়ে রাখা থাকবে অস্ত্র কেনার চাপ। কেউ চাইবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, কেউ চাইবে অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান, কেউ চাইবে নিজস্ব পারমাণবিক সক্ষমতা গড়ে তোলার কৌশলগত সহযোগিতা।
সৌদি আরবের জন্য এটি হবে অস্তিত্বগত প্রশ্ন। তারা দীর্ঘদিন ধরেই ইরানকে নিজেদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। যদি ইরান পারমাণবিক পরীক্ষা করে, তাহলে সৌদি আরব ন্যাটোর সাহায্য ছাড়াও সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুজাতিক চুক্তিতে যাবে। প্রতিরক্ষা বাজেট কয়েক বিলিয়ন ডলার থেকে লাফিয়ে উঠবে শত বিলিয়নের ঘরে। একইভাবে তুরস্কের নেতৃত্বও অনেক আগে থেকেই পারমাণবিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছে। ইরান এগিয়ে গেলে তুরস্ক পেছনে থাকবে না।
অন্যদিকে কাতার ও মিশরের মতো দেশগুলো হয়তো সরাসরি হুমকির মুখে নয়, তবে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদেরকেও একটি পক্ষ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ, সৌদি-ইসরায়েলের লবি এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য এ দেশগুলোও বড় অর্ডার দেবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র কোম্পানিগুলো যেমন লাভবান হবে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্যও মারাত্মকভাবে বদলে যাবে।
যখন পারমাণবিক অস্ত্রের নামে ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি ডলারের চুক্তি হয়, তখন আসলে যুদ্ধ এক ধরনের পণ্য হয়ে দাঁড়ায়। Lockheed Martin, Raytheon, Boeing কিংবা General Dynamics-এর মতো কোম্পানিগুলো তখন রাজনীতির ছায়ায় বসেই ব্যবসা করে। এই যুদ্ধ সবার জন্য নয়—এটি গুটিকয় এলিটের ব্যবসায়িক জয়যাত্রা। আর সেই যাত্রার জ্বালানী হলো অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক আর যুদ্ধের সম্ভাবনা।
ইরান যদি পারমাণবিক পরীক্ষা করে, তাহলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র বিক্রি বাড়বে, সামরিক ঘাঁটি পুনঃবিন্যস্ত হবে, এবং বিশ্ব রাজনীতিতে ‘শান্তির রক্ষক’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগও পাবে। অথচ আসলে সেই আগুনটা কারা ছড়ায়, সেটা অনেক সময় ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লেখা হয় না। সাধারণ মানুষ কেবল দেখে, টেলিভিশনে যুদ্ধের ছবি, সংবাদে বিশ্লেষণ আর বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
একটি পারমাণবিক পরীক্ষা মানে শুধু বিজ্ঞান বা প্রতিরক্ষা নয়, তা একটি বহুপার্শ্বীয় লাভক্ষতির খেলা। এবং সেই খেলায় সবচেয়ে বেশি হাসে যারা যুদ্ধ থেকে সরাসরি আয় করে। এই বাস্তবতায় যুদ্ধ কখনোই আর শুধু বোমা-গুলির লড়াই নয়, এটি হয়ে উঠেছে করপোরেট লড়াই—ডলার, চুক্তি আর জিওপলিটিক্সের অদৃশ্য চক্রে বাঁধা এক দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার প্রকল্প।
– প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আপনার মতামত লিখুন