যুদ্ধ, বিপ্লব ও বিশ্বাসে গড়া হোসেইন সালামির জীবন

মনিরুল ইসলাম :
প্রকাশ: ১৩ জুন, ২০২৫, ৫:৪৩
যুদ্ধ, বিপ্লব ও বিশ্বাসে গড়া হোসেইন সালামির জীবন

জেনারেল হোসেইন সালামি, ছবি - তেহেরান টাইমস।

জেনারেল হোসেইন সালামি ছিলেন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পস (IRGC)-এর অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। সালামি ২০১৯ সাল থেকে গার্ডস বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার নেতৃত্বে এই সংস্থাটি শুধু ইরানের নিরাপত্তার রক্ষক হিসেবে নয়, বরং একটি আঞ্চলিক প্রভাবশালী সামরিক ও কৌশলগত শক্তিতে পরিণত হয়। তার রাজনৈতিক অবস্থান, আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামরিক কৌশলের কারণে তিনি শুধু ইরানে নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে একজন প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে পরিগণিত হন।

হোসেইন সালামির জন্ম ১৯৬০ সালে ইরানের ইসফাহান প্রদেশের গলপায়েগান শহরে। ইসলামি বিপ্লবের পরপরই তিনি রেভল্যুশনারি গার্ডসে যোগ দেন এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ফ্রন্টলাইনে নেতৃত্ব দিয়ে দ্রুত উঠে আসেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কৌশল গবেষণার কাজে যুক্ত হন এবং আইআরজিসি’র উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজের জায়গা সুসংহত করেন। অ্যারোনটিক্স ও অ্যাভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করা সালামি পরবর্তীতে মালেক আস্তার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৯ সালে তিনি আইআরজিসির কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ পান। তার দায়িত্ব গ্রহণের সময় থেকেই ইরানের সামরিক নীতি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের সামরিক উপস্থিতি এবং হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য মিত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় ছিল তার নির্দেশনায়। কুদস ফোর্সের কার্যক্রমেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং ইরানের ‘প্রক্সি ওয়ারফেয়ার’ কৌশলের মূল নকশাকার হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়।

সামরিক নেতা হলেও সালামির ভূমিকা ছিল আদর্শিক ও রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইসলামী বিপ্লবের আদর্শকে দেশের বাইরে রপ্তানির পক্ষে ছিলেন এবং পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিতেন। তার মতে, প্রতিরক্ষা কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, বরং একটি সক্রিয় অবস্থান যেখানে শত্রুর আগ্রাসনের পূর্বেই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েলের পরিচালিত হামলায় তিনি নিহত হন। ওই হামলায় তেহরানে আইআরজিসির সদর দপ্তর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। একই হামলায় নিহত হন ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান ফারেদুন আব্বাসি এবং পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহেদি তেহরানচি। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন হামলার খবর নিশ্চিত করে জানায়, হামলার সময় সালামি সদর দপ্তরেই অবস্থান করছিলেন।

তার মৃত্যু ইরানকে শুধু সামরিকভাবে নয়, রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এক বিবৃতিতে বলেন, “সালামি ছিলেন বিপ্লবের নিঃস্বার্থ সৈনিক এবং ইসলামের সেবায় নিয়োজিত এক আদর্শবান নেতা।” বিশ্লেষকদের মতে, সালামির মৃত্যু আইআরজিসি’র ভবিষ্যৎ নীতিমালায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।

জেনারেল হোসেইন সালামির জীবন ছিল বিপ্লব, যুদ্ধ, আদর্শ ও কর্তব্যের এক বিস্তৃত অধ্যায়। তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যার পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি আজকের ইরানকে গঠন করেছে। তার শূন্যতা শুধু আইআরজিসি নয়, বরং গোটা ইরানি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায় সৃষ্টি করবে।