সৈয়দাবাদ সরকারি কলেজে সিন্ডিকেটের শাসন: দুর্নীতি ও অনিয়মের পাহাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রকাশ: ২৬ মে, ২০২৫, ৬:৩৮
সৈয়দাবাদ সরকারি কলেজে সিন্ডিকেটের শাসন: দুর্নীতি ও অনিয়মের পাহাড়

সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয় সৈয়দাবাদে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক শফিকুল ইসলাম চৌধুরী শফিক (ফেসবুকে পরিচিত ‘শফিকুল ইসলাম চৌধুরী জান্নাত’) এবং কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল ওয়াহেদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। কলেজের ভেতরে-ভেতরে গড়ে ওঠা দুর্নীতির সিন্ডিকেট নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষক-কর্মচারী, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ রয়েছে, এই দুজনের নেতৃত্বে কলেজে লুটপাটের একপ্রকার উৎসব শুরু হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন খাতের অর্থ নয়ছয় করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হচ্ছে। কলেজের শিক্ষক পরিষদের অটো সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া শফিকুল ইসলাম চৌধুরী নিজ রাজনৈতিক পরিচয় এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের ঘনিষ্ঠতা জাহির করে কলেজে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। স্থানীয় সাবেক এমপি ও সরকারি দলের লোকজনের স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং প্রভাব খাটিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্রিয় রয়েছেন। সাবেক ইংরেজি প্রভাষক ফাহিমা খাতুনের ব্যক্তিগত সহযোগী ও বর্তমানে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ওসমান গনি সজিবের ছত্রছায়ায় থেকেই তার ক্ষমতা বৃদ্ধির সূচনা হয় বলে জানা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, ২০২৩ ও ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে কলেজের চারটি অনার্স বিভাগ এবং ডিগ্রি পাসকোর্সে নবীনবরণ আয়োজনের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হলেও কোনও অনুষ্ঠান হয়নি এবং সেই টাকার কোনও হিসাবও কলেজ প্রশাসনে নেই। উন্নয়ন খাতেও একই ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে প্রাপ্ত উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দে টিচার্স কমনরুম ও অধ্যক্ষের কক্ষে টাইলস ও পর্দা লাগানোর খাতে দেখানো হয়েছে সাত লাখ টাকার ব্যয়, যদিও অভিজ্ঞ কারিগরি কর্মীদের মতে এই কাজের প্রকৃত ব্যয় এক লাখ টাকারও নিচে। কলেজের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ডিজির উন্নয়ন বাজেটের টাকা থেকে শুরু করে ছাত্রদের কাছ থেকে নেওয়া উপবৃত্তির অর্থ পর্যন্ত কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। সবকিছুই ভাগাভাগি হয়ে যায়।

আর এসব ভাগাভাগিতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় শফিক স্যার ও অধ্যক্ষ সাহেব। ২০২৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ‘বিশেষ সুবিধা’ দেওয়ার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুই কিস্তিতে ৯০০ টাকা করে আদায় করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। পরীক্ষার্থীদের একজন জানান, “সবার কাছ থেকেই টাকা নেওয়া হয়েছিল, বলা হয়েছিল পরীক্ষা ভালোভাবে দিতে সাহায্য করবে। পরে দেখলাম, সেই টাকা কেউ ফেরত দিল না, কেউ জবাবও দিল না।” অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, “অধ্যক্ষ স্যার নিজে বলেছিলেন, এই টাকা পরীক্ষা পরিচালনার খরচ, কিন্তু পরের বছর আমরা দেখলাম কোনও খরচই হয়নি, শুধু টাকা গায়েব।”

একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, “সরকারি কলেজে আমাদের সন্তানদের উপবৃত্তির টাকা সরকারি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আসে, কিন্তু এখানে উল্টোভাবে টাকা চাওয়া হয়। IESF রেজিস্ট্রেশনের নামেও টাকা নেয়, অথচ সরকার এসব ফি বহন করে। টাকা দিলে কাজ হয়, না দিলে নানা রকম হয়রানি করে।” কলেজের অভ্যন্তরে গঠন করা বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে এই লোপাট ও ভাগাভাগির কাজ করা হয়। শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে এসব কমিটিতে শফিকুল ইসলাম চৌধুরী নিজেই সক্রিয় থাকেন, যেখান থেকে টাকা ভাগাভাগির পরিকল্পনা হয় বলে অভিযোগ আছে।

সাম্প্রতিক সময়ে অভিযোগ উঠেছে, শফিকুল ইসলাম চৌধুরী তার নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর হাই স্কুলেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন এবং সেখানে লুটপাটের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন। স্থানীয় কয়েকজন জানান, “শফিক স্যার মাঝেমধ্যে এখানে এসে স্কুল নিয়ে কথা বলেন, উন্নয়ন আনবেন বলে নানা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আমরা জানি, উনার চরিত্র কী রকম, সৈয়দাবাদ কলেজে কী করছেন সেটা সবাই জানে।” অন্যদিকে, শফিকুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে নারী সহকর্মী ও ছাত্রীদের উত্যক্ত করার অভিযোগও রয়েছে, যার বিষয়ে কলেজের কয়েকজন শিক্ষক প্রশাসনকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছু জানানো হয়নি।

সরকারি আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রশাসনিক প্রধানের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। একাধিক সূত্র বলছে, এসব অভিযোগের বেশিরভাগই প্রমাণযোগ্য এবং কলেজে আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।

বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। অভিযোগ এর বিপরীতে কথা বলতে চাইলে একাধিকবার ফোন এবং খুদেবার্তা দিয়েও প্রভাষক শফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। প্রিন্সিপাল আব্দুল ওয়াহেদ হজ্জের অজুহাতে এড়িয়ে গিয়ে সমস্ত অভিযোগ এর ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়ে তার কলেজে প্রতিবেদককে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছেন।