ডিপিডিসির প্রকৌশলী রাজ্জাকের দুর্নীতির সাম্রাজ্য

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)-র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক একজন সরকারি চাকরিজীবী। কিন্তু তার জীবনযাপন, সম্পদের পরিমাণ এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে এমন ধারণা করাটা স্বাভাবিক যে তিনি যেন একজন শিল্পপতি। অথচ, একাধিক তদন্ত ও নথি বলছে—এই সম্পদের পেছনে রয়েছে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তোলা এক চক্র।
শুরুটা সরকারি চাকরি, এরপর দুর্নীতির উল্লম্ফন
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার হাসলীগাঁও গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ডিপিডিসির মগবাজার ডিভিশনে উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি নিয়ম লঙ্ঘন করে একাধিক ধাপ টপকে সরাসরি সিদ্ধিরগঞ্জ ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী হয়ে যান।
এই সময় থেকেই শুরু হয় তার সম্পদ গড়ার বিস্তৃত কার্যক্রম। সাভারের ভাকুর্তায় ৩০ কাঠা জমির ওপর নির্মাণ করেন ‘ওশাকা পাওয়ার লিমিটেড’ নামে একটি সাব-স্টেশন নির্মাণ কারখানা। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমানে সেটি একটি কাঠের দরজার ফ্যাক্টরিকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে—যার ভেতরে এখনো ছড়িয়ে রয়েছে সাব-স্টেশনের নানা সরঞ্জাম।
ডিপিডিসির সরঞ্জাম বিক্রিতে জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ
রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, ডিপিডিসির গ্রাহকদের উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হলে বাধ্য হয়ে তার কোম্পানি ‘ওশাকা পাওয়ার’ থেকে নিম্নমানের সাব-স্টেশন সরঞ্জাম কিনতে হতো। নতুবা তাদের পড়তে হতো নানা ধরনের প্রশাসনিক হয়রানিতে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২২ সালে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি বলেছে—ওশাকা পাওয়ারের ৩০০ ট্রান্সফরমারের মধ্যে ১৯১টিই ‘মানহীন’। কিন্তু এসব প্রমাণ সত্ত্বেও রাজ্জাকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তদন্ত কমিটি, কিন্তু প্রধান অভিযুক্তকে ‘অব্যাহতি’
ডিপিডিসির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু হেনা মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠিত হলে রাজ্জাকের সিন্ডিকেটের ৮ সদস্য চিহ্নিত হয়। তাদের মধ্যে ৭ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও রাজ্জাক থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। বরং, তদন্ত কমিটির প্রধান মোস্তফা কামালকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়।
সম্পদের পাহাড়: সরকারি বেতন দিয়ে সম্ভব?
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা মডেল টাউনে রাজ্জাকের দুটি বিলাসবহুল ফ্লাট রয়েছে, অভিযোগ রয়েছে এ চন্দ্রিমা হাউজিং কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে ফ্লাটগুলো বাগিয়ে নিয়েছে। গাজীপুরে রয়েছে আরেকটি বহুতল ভবন। তার নিজ জেলা শেরপুরে রয়েছে পাঁচ একর জমির দোতলা বাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, বিশাল মাছের খামার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
‘দানবীর’ পরিচয়ে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুললেও স্থানীয় সূত্র বলছে, এই সম্পদের উৎসের অনেকটাই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত।
বদলি আদেশ বাতিল, পরদিন নতুন পদে নিয়োগ
প্রকৌশলী রাজ্জাকের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, ১৫ আগস্ট তাকে সিস্টেম কন্ট্রোল অ্যান্ড স্ক্যাডার দপ্তরে বদলি করা হলেও মাত্র ২৬ দিনের মাথায় তার বদলি বাতিল করা হয়। একই দিনে তাকে পুনরায় ‘ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ দপ্তরে বসানো হয়।
প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবসা
রাজধানীর পান্থপথে অফিস খুলে স্ত্রীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে ‘ওশাকা পাওয়ার’-এর ব্যবসা পরিচালনা করেন রাজ্জাক। একাধিক প্রকল্পে ওশাকার ট্রান্সফরমার ব্যবহার করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও তদন্তে উঠে আসে। ডিপিডিসির এক উপসহকারী প্রকৌশলী অভিযোগ করেছেন—রাজ্জাকের কারণে মানহীন ট্রান্সফরমার ব্যবহারে অগ্নিকাণ্ডসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটেছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও চাঁদাবাজির অভিযোগ
ডিপিডিসির ক্ষমতাধর ‘বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে রাজ্জাক বদলি, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অপ্রতিহত প্রভাব বিস্তার করেন। এমনকি শেরপুর বা ময়মনসিংহ বিভাগে কোনো সরকারি অনুষ্ঠান হলেই প্রকৌশলীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা চাঁদা আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা না থামলে প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখে
আবদুর রাজ্জাক নামের এই প্রকৌশলী একজন ‘দানবীর’ নাকি ‘দুর্নীতির দানব’—সেই প্রশ্নই এখন উঠছে। তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত শত কোটি টাকার মালিক, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সিন্ডিকেট প্রধান এবং মানহীন যন্ত্রাংশ সরবরাহের মাধ্যমে জননিরাপত্তা হুমকিতে ফেলেছেন। এত কিছুর পরও তাকে বরখাস্ত তো দূরে থাক, জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি।
যদি দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিদ্যুৎ বিভাগ এখনো নীরব থাকে, তবে এটি হবে কেবল একজন কর্মকর্তার দায় নয়—একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার নাম।
উল্লেখ্য, অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)-র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাককে বারবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন