শিক্ষানগরীর ছায়ায় নিঃশব্দ এক জীবন

সজল মাহমুদ :
প্রকাশ: ৬ জুন, ২০২৫, ১২:০৫
শিক্ষানগরীর ছায়ায় নিঃশব্দ এক জীবন

৫ জুন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটা। রাজশাহীর সিএনবি মোড় অনেকটাই ফাঁকা। দু-একটা রিকশা, কিছু পথচারী আর দূরে ট্রাফিক পুলিশের হুইসেলের শব্দ। মোড়ের এক পাশে ফুটপাত ঘেঁষে পড়ে আছে একটি নিথর দেহ। প্রথমে মনে হয়, কেউ হয়তো ঘুমিয়ে আছেন। কাছে যেতেই বোঝা যায়—এ ঘুম নয়, এক দীর্ঘশ্বাসমিশ্রিত বেঁচে থাকা।

রাজশাহী—বাংলাদেশের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল, গবেষণাগার—চারপাশে জ্ঞানের বাতিঘর। অথচ সেই শহরেরই কেন্দ্রস্থলে এক নিঃসঙ্গ মানুষ পড়ে আছেন অবহেলার চাদরে ঢাকা পড়ে।

ফুটপাতের চায়ের দোকানি বলেন, “ওই লোকটা অনেকদিন ধরেই দেখতেছি। কখনো এখানে, কখনো রেলস্টেশনে। চুপচাপ থাকে। কিছু চায় না, কেউ কিছু দেয়ও না।” কণ্ঠে দয়া নেই, যেন ওই মানুষটি তার শহরের ‘দাগ’।

রিকশাচালক আলাল হোসেন বলেন, “একদিন দুই টাকার বিস্কুট দিছিলাম। নিছিল, কিচ্ছু কইল না। চোখ বড় বড় কইরা শুধু তাকায়া থাকল।” কিছুক্ষণের থেমে বলেন, “রাজশাহীতে কত শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু ফুটপাতে একজন মানুষ পড়ে থাকলেও কেউ এক কাপ চা পর্যন্ত দেয় না। শিক্ষা থাকলে মনুষ্যত্ব কই?”

চারপাশে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, ক্লাস-পরীক্ষার ব্যস্ততা, ঈদের কেনাকাটায় গমগম শহর। কিন্তু সেই শহরেরই এক কোণে পড়ে থাকা এই মানুষটির ঈদ নেই। আনন্দ নেই। উৎসব নেই।

পাশেই শহীদ কামারুজ্জামান চত্বর, বিপণিবিতান, ব্যস্ত বইয়ের দোকান, ক্যাম্পাসের আড্ডা। কিন্তু কেউ থামে না। কেউ জিজ্ঞেস করে না—“ভাই, আপনি ঠিক আছেন তো?”

রাজশাহীর এমন মানুষটির কোনো পরিচয় নেই। হয়তো অনেকের মতোই হারিয়ে গেছেন রাষ্ট্রের রেকর্ড থেকে। তারা নেই জাতীয় উন্নয়নের ভাষণে, নেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে। শুধু পড়ে থাকেন সমাজের প্রান্তে—একাকী, উপেক্ষিত।

কয়েক বছর আগে ‘সিটি শেল্টার’ প্রকল্পের ঘোষণা এসেছিল। বাস্তবায়ন হয়নি। হেল্পলাইন নেই, কার্যকর আশ্রয়কেন্দ্র নেই। সিটি করপোরেশন, সমাজসেবা অধিদপ্তর, এনজিও—সবকিছুই আছে, কেবল পাশে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা নেই।

এই মানুষটি আমাদের চোখের সামনে থাকা এক আয়না। যেখানে প্রতিফলিত হয় শিক্ষিত শহরের নির্লিপ্ততা। যে শিক্ষা মানুষের প্রতি দায়িত্ব তৈরি করে না, তা কীভাবে গর্বের বিষয় হতে পারে?

শুধু রাষ্ট্র নয়, দায় আমাদেরও। একটুখানি সহানুভূতি, একবার থেমে তাকানো, হয়তো এক কাপ চা—এই ছোট ছোট কাজই কাউকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে।

সিএনবি মোড়ের সেই নিঃশব্দ মানুষটি হয়তো আজ রাতেও পড়ে থাকবেন নিঃসঙ্গ ফুটপাতে। আর আমরা—জ্ঞানী, শহুরে, ব্যস্ত—চলে যাব পাশ কাটিয়ে।