বারকাতই জনতা ব্যাংক শেষ করে দিয়েছেন, সাবেক অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য ও পেছনের গল্প

বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রকাশ: ১১ জুলাই, ২০২৫, ৭:৫৫
বারকাতই জনতা ব্যাংক শেষ করে দিয়েছেন, সাবেক অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য ও পেছনের গল্প

জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতকে গ্রেফতারের পর ব্যাংকটির দুর্নীতির ইতিহাস ও তৎকালীন ব্যবস্থাপনায় তাঁর ভূমিকা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে ওঠা একটি পুরনো সংবাদ প্রতিবেদনও আবার সামনে এসেছে, যা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি—’একক ব্যক্তির ঋণে বৃহত্তম কেলেঙ্কারি’ শিরোনামে।

প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিনই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, জনতা ব্যাংক একসময় দেশের সেরা ব্যাংক ছিল, কিন্তু আবুল বারকাতই ব্যাংকটি শেষ করে দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য ছিল, ‘বারকাত এত বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছেন, আমি তো জানিই না। তার সময়ে ৩০০-৪০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব এখন খারাপ উদাহরণ হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শুধু ব্যাংকই বিপদে পড়েনি, বরং যারা তখন ঋণ নিয়েছে তারাও এখন দেউলিয়া।’ 

এ সময় পাশে বসা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন মন্তব্য করেন, আপনিই তো বারকাতকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। জবাবে মুহিত বলেন, হ্যাঁ, আমিই দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন তার দায়ভার বারকাতকেই নিতে হবে।

ফিরে দেখা বারকাতের জনতা ব্যাংক

জনতা ব্যাংক ভয়ংকর রকম উদারভাবে এক গ্রাহককে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা দিয়েছিল। যা তখনকার সময়ে ব্যাংকের মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের মোট মূলধন হিসেবে করে একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ ছিলনা।

ফলে বিপাকে পড়েছিল ব্যাংক, এবং গ্রাহকও এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ।যে ধাক্কা আর কাঁটিয়ে উঠতে পারেনি জনতা ব্যাংক।

এই ঋণ বিতরণ হয় ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত ছিলেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান।

ওই সময় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন বলরাম পোদ্দার, নাগিবুল ইসলাম দীপু, আবু নাসেরসহ রাজনৈতিক পরিচয়ের একাধিক ব্যক্তি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই পর্ষদই বারবার সিদ্ধান্ত নিয়ে খেয়ালখুশিমতো ঋণ বিতরণ করেছে।

ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহক এননটেক্স গ্রুপ, যার নেতৃত্বে আছেন ইউনুস (বাদল)। তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ২২টি প্রতিষ্ঠানের নামে এই ঋণ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ কম দেখাতে এসব প্রতিষ্ঠানকে তিনটি আলাদা গ্রুপ হিসেবে দেখিয়েছে, যদিও প্রকৃত মালিক একজনই।

এই বিশাল অঙ্কের ঋণ অনুমোদিত হয়েছে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ২৪টি বোর্ড সভায়।

ব্যাংকের করপোরেট শাখা এত ঋণ বিতরণ করেছিল যে নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও হারিয়েছিল। তখন ঋণের বড় অংশ পরিশোধ না হওয়ায় ঋণগুলো পুনঃতফসিলের আশ্রয় নিয়েছিল ব্যাংক।

শুধু তাই নয় একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারিতেও নিরব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকের সিবিএ নেতাসহ একাধিক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মকর্তার মিলেমিশে লুটপাট করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠে, তখনকার ঋণ কেলেঙ্কারিকে এখন অনেকেই হল-মার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির চেয়েও ভয়াবহ বলে মনে করেন।

ইউনূস বাদল: গাড়িচোর মামলার আসামি থেকে হাজার কোটি টাকার ‘দানবীর’ শিল্পপতি

ইউনূস বাদলের জীবনের গল্প সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। ২০০৭ সালে যিনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ‘গাড়িচোর চক্রের নেতা’ হিসেবে, তিনিই মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ‘বিশেষ গ্রাহক’।

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ইউনূস বাদলের বেড়ে ওঠা ছিল অভাব-অনটনের মধ্যে। লেখাপড়া শেষ না করেই কর্মজীবন শুরু করেন বাসচালকের সহকারী হিসেবে। পরবর্তীতে বাবার বিদ্যুৎ অফিসে চাকরির সুবাদে একটি অস্থায়ী চাকরি পান সেখানে। এখান থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। অর্থের উৎস ও ক্ষমতার বলয় খুঁজে পেয়ে রাজনীতিকদের সঙ্গে গড়ে তোলেন ঘনিষ্ঠতা।

নিয়মকানুন ও সীমা লঙ্ঘন করে এ ব্যাংক থেকেই তিনি নেন প্রায় ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। একে একে গড়ে তোলেন ২২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নাম দেন এ্যাননটেক্স গ্রুপ।

এই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, লামিসা স্পিনিং, ইয়ার্ন ডায়িং, জুভেনিল সোয়েটার্স, সিমি নেট টেক্স, সুপ্রভ কম্পোজিট, এফকে নিট, সিমরান কম্পোজিট, জারা নিট টেক্স, গ্যাট নিট টেক্স, জেওয়াইবি নিট টেক্স, এম এইচ গোল্ডেন জুট, জ্যাকার্ড নিট টেক্স, স্ট্রাইগার কম্পোজিট, আলভি নিট টেক্স, এম নুর সোয়েটার্স, গ্যালাক্সি সোয়েটার, জারা লেভেল অ্যান্ড প্যাকেজিং, সুপ্রভ মিলাঞ্জ স্পিনিং, শাইনিং নিট টেক্স, জারা ডেনিম, সুপ্রভ রোটর স্পিনিং।

বাদলের পরিচিতি সেই ‘চোর সন্দেহভাজন ব্যক্তি’ নয়, তিনি পরিচিত একজন দানবীর, মসজিদ নির্মাতা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে।

কিন্তু তার এই উত্থানের পেছনের গল্প ব্যাংক জালিয়াতি, অনৈতিক প্রভাব, এবং ঋণ খেলাপির দুষ্টচক্র বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থার এক নগ্ন উদাহরণ হয়ে রয়েছে।