রক কিংবদন্তি ওজি অসবর্ন আর নেই

মৃত্যুর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে ‘ব্যাক টু দ্য বিগিনিং’ শীর্ষক বিদায়ী কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন রক আইকন। বিশ্বখ্যাত রকস্টার ওজি অসবর্ন, যিনি ‘অন্ধকারের রাজপুত্র’ নামে পরিচিত ছিলেন, ৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন।
অসবর্ন পরিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমাদের প্রিয় ওজি অসবর্ন আজ সকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি পরিবারের সান্নিধ্যে এবং ভালোবাসায় ঘেরা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা এই সময়ে পরিবারের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সকলের সহানুভূতি কামনা করছি।
তাঁর মৃত্যুর কারণ স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন, যার মধ্যে পারকিনসনস, হাড় ও মেরুদণ্ড সংক্রান্ত জটিল অস্ত্রোপচার অন্যতম।
অন্ধকার থেকে আলোয়—অজি অসবর্নের দীর্ঘ সংগীতযাত্রা
বার্মিংহামের অ্যাস্টনে ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন জন মাইকেল ‘অজি’ অসবর্ন। কারখানা শ্রমিকের সন্তান হিসেবে বড় হওয়া এই কিশোরের জীবন ছিল সংগ্রামে ভরা। ১১ বছর বয়সে যৌন নিপীড়নের শিকার হন, পরে চুরির দায়ে কারাগারেও যেতে হয়েছিল। অথচ এই বিভীষিকাময় জীবনই পরবর্তীতে রূপ নেয় বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রক ধ্বনিতে।
১৯৭০ সালে ব্ল্যাক সাবাথ ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে ওজি বিশ্ব সংগীতের মানচিত্র বদলে দেন। ‘Paranoid’, ‘Iron Man’, ‘War Pigs’, ‘Master of Reality’ এ সব গান হেভি মেটালের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচিত হয়।
তাঁর গলা ছিল অদ্ভুত রকমের কর্কশ ও গা ছমছমে, যা ভয়, বিষাদ ও বিদ্রোহের এক অনন্য সংগীতরূপ দিয়েছিল।
বিতর্কিত জীবন, উজ্জ্বল উত্তরাধিকার
ব্ল্যাক সাবাথের সঙ্গে পাঁচটি অ্যালবাম করার পর মাদক ও অ্যালকোহলের আসক্তি এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, ১৯৭৯ সালে তাকে ব্যান্ড থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে ব্যান্ডে ফিরে এলেও একক ক্যারিয়ারে Blizzard of Ozz, Diary of a Madman, No More Tears এবং সাম্প্রতিক Ordinary Man অ্যালবামগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
তিনি পোস্ট ম্যালোন, ট্র্যাভিস স্কট এবং এলটন জনের সঙ্গেও গান করেছেন।
বাদুড় কামড় ও ‘পাগলামি’র রাজপুত্র
১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক কনসার্টে মঞ্চে থাকা মৃত বাদুড়কে প্রপস ভেবে কামড়ে দেন ওজি। পরে হাসপাতালে গিয়ে রেবিস টিকা নিতে হয়। তার আগেও একটি রেকর্ড লেবেলের সভায় দুইটি কবুতরের মাথা কামড়ে দেন তিনি—যা সংগীত ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা।
একবার স্ত্রী শ্যারন অসবর্নকে মদ্যপ অবস্থায় গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তবু শ্যারনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কখনো কখনো বিচ্ছিন্ন হলেও, শেষ পর্যন্ত তা টিকে যায়।
বাস্তবতার পর্দায় ‘দ্য অসবর্নস’
২০০২ সালে MTV রিয়েলিটি শো The Osbournes তাঁকে এনে দেয় নতুন জনপ্রিয়তা। তাঁর স্ত্রী শ্যারন ও সন্তান কেলি ও জ্যাককে নিয়ে তৈরি সেই শোয়ে ওজির পাগলামি, হিউমার ও সংবেদনশীলতা মানুষকে মুগ্ধ করেছিল। এই শো ২০০২ সালে ‘আউটস্ট্যান্ডিং রিয়েলিটি প্রোগ্রাম’ ক্যাটাগরিতে এমি অ্যাওয়ার্ড জেতে।
শারীরিক অসুস্থতা ও চূড়ান্ত বিদায়
২০০৩ সালে চতুর্চক্র (কোয়াডবাইক) দুর্ঘটনায় ওজি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে ২০০৫ সালে ধরা পড়ে পারকিনসন্স-সদৃশ “পারকিন সিনড্রোম”। ২০২০ সালে তিনি সরাসরি পারকিনসন রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ২০২২ সালে তিনি মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করান, যা পূর্ববর্তী দুর্ঘটনার জটিলতা আরও বাড়িয়ে তোলে।
এই শারীরিক দুর্বলতার কারণেই ২০২৩ সালে ইউরোপ-যুক্তরাজ্য সফর বাতিল করেন।
২০২৫ সালের মে মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, প্রতিদিন সকালে জেগে দেখি শরীরের আরেকটা অংশ কাজ করছে না। মনে হয়, এই যন্ত্রণা কোনোদিন শেষ হবে না।
তাঁর স্ত্রী শ্যারন তখন বলেন, তোমার জীবনে একটা উদ্দেশ্য লাগবে।
সেই উদ্দেশ্য ছিল ৫ জুলাই ‘ব্যাক টু দ্য বিগিনিং’ কনসার্ট।
বার্মিংহামের ভিলা পার্কে আয়োজিত সেই কনসার্টে ব্ল্যাক সাবাথের টনি আয়োমি, গিজার বাটলার ও বিল ওয়ার্ডের সঙ্গে মঞ্চে ফেরেন ওজি। একই কনসার্টে অংশ নেন মেটালিকা, গানস এন’ রোজেস ও স্লেয়ার-এর মতো ব্যান্ডগুলোও।
বিদায়, অন্ধকারের রাজপুত্র
ওজি অসবর্ন হয়তো চলে গেলেন, কিন্তু তিনি রেখে গেলেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। অন্ধকার, পাপ, বিভ্রান্তি, দুঃখ, সবকিছুকে সংগীতে রূপ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে এক ছিন্নমূল যুবক হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব সংগীতের অবিসংবাদিত পুরুষতারা।
আজও তার কণ্ঠে বাজে ‘Crazy, but that’s how it goes’… আর তাই, ওজি অসবর্নকে মনে রাখবে দুনিয়া, চিরকাল।
-গার্ডিয়ান থেকে
আপনার মতামত লিখুন