পিরোজপুরের ভাসমান পেয়ারা বাজার, পর্যটনে নতুন প্রাণ

এশিয়ার বৃহত্তম ভাসমান পেয়ারা বাজার গড়ে উঠেছে পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরিশাল জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায়। বর্ষার শুরুতেই জমে উঠেছে এই পেয়ারা বাজার, আর এর আকর্ষণে প্রতিদিনই ভিড় করছে হাজারো পর্যটক। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে নৌকা ভ্রমণ, পানিতে ভেসে ভেসে বাজার দেখা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসছেন অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু।
এই অঞ্চলে প্রায় ৩১ হাজার একর জমিতে পেয়ারা চাষ হচ্ছে, যা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রায় ২০ হাজারের বেশি পরিবার পেয়ারা চাষ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার অন্তত ২৫টি গ্রামে এ বছর পেয়ারা উৎপাদন হয়েছে। বিশেষ করে আটঘর, কুড়িয়ানা, আদমকাঠি, ধলহার, জিন্দাকাঠি, আন্দাকুল, ব্রাহ্মণকাঠি, পূর্ব জলাবাড়ীসহ বহু গ্রামে প্রায় ৭১৬ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে পেয়ারা। এসব বাগানে কাঁচা-পাকা পেয়ারায় ঝুলছে গাছের ডালে ডালে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, আগের মৌসুমগুলোর তুলনায় এবার ফলন কিছুটা কম হলেও বাজারে পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ভালো দামে। প্রতি মণ পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। এই মৌসুমে প্রতিদিন পানির ওপর বসছে পেয়ারা হাট, যেখানে শত শত নৌকায় করে পাইকাররা পণ্য নিয়ে আসছেন ও কিনে নিচ্ছেন।
পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় একজন শ্রমিক জানান, এ খাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অন্তত ৮ থেকে ১০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। মৌসুমে চাহিদা বাড়ে শ্রমিকের, বাড়ে আয়ও।
পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার কুরিয়ানা খালের ওপর দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে এই ভাসমান বাজার। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র—এই তিন মাস পেয়ারার মৌসুম, আর শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে এ বাজারে থাকে উৎসবের আমেজ।
পর্যটকদের পদচারণায় মুখর বাজার
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। কেউ আসছেন পরিবারসহ, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে। কেউ আবার একান্তেই এই প্রাকৃতিক আনন্দ উপভোগ করতে ছুটে আসছেন।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক ইসান আহমেদ বলেন, “আমরা ২০ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে এসেছি। এখানে এসে সবাই মুগ্ধ। এ দৃশ্য বারবার দেখার মতো।”
বরিশাল থেকে আসা দম্পতি লুনা আক্তার ও রফিক হোসেন বলেন, “এটা যেন বাংলাদেশের থাইল্যান্ড! এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ভাসমান বাজার থাইল্যান্ডকেও হার মানায়।”
পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনের তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। পিরোজপুরের পুলিশ সুপার খাঁন মুহাম্মদ আবু নাসের জানান, “দেশ-বিদেশের পর্যটকরা যাতে নিশ্চিন্তে ঘুরে দেখতে পারেন, সে জন্য নিয়মিত পুলিশ টহল এবং বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
কৃষিতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
পিরোজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. রেজাউল হাসান জানান, “এ বছর ৭১৬ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়েছে। এখানে শত বছর ধরে চাষ হলেও এখন তা অ্যাগ্রোট্যুরিজমে পরিণত হয়েছে। জুলাই-আগস্টে প্রায় ৪ লাখ পর্যটক আসবেন বলে আশা করছি।”
তিনি আরও জানান, কৃষি বিভাগ দেশীয় জাতের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল জাতের পেয়ারা চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছেন এবং পাশাপাশি পেয়ারাকে কেন্দ্র করে জ্যাম-জেলি তৈরির উদ্যোগ নিতে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সহায়তা করছে।
পিরোজপুরের ভাসমান পেয়ারা বাজার শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, পর্যটন, কর্মসংস্থান ও সংস্কৃতি—সব দিক থেকেই সম্ভাবনাময়। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চল আরও বড় পরিসরে কৃষি ও পর্যটন সম্ভাবনায় রূপ নিতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন