চিরবৈরী প্রতিবেশী: সামরিক শক্তিতে কে কতটা এগিয়ে ভারত না পাকিস্তান?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে গত দুই দিনে (মে ৬-৭, ২০২৫) সংঘর্ষ ও বিমান হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছেন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভারতীয় বিমান হামলায় অন্তত ৩১ জন পাকিস্তানি নিহত এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন। এদিকে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে ১৫ ভারতীয় নিহত এবং ৪৩ জন আহত হয়েছেন।
পাকিস্তান দাবি করেছে যে, ভারতীয় বিমান হামলায় ৫টি যুদ্ধবিমান ও ১টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। অপরদিকে, ভারতীয় বিমান বাহিনী জানিয়েছে, পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে ৩ ভারতীয় নিহত হয়েছেন।
এই সংঘর্ষগুলি কাশ্মির সীমান্তে সংঘর্ষের নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে আবারও আলোচনায় এসেছে তাদের সামরিক শক্তি ও প্রস্তুতির বিষয়টি।
সীমান্ত উত্তেজনা, পাল্টাপাল্টি হুমকি এবং কৌশলগত শক্তি প্রদর্শনের এই সময়ে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক শক্তির দিক থেকে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও, পারমাণবিক অস্ত্র ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে পাকিস্তানও পিছিয়ে নেই।
ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি, যা আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি অর্জনে সহায়ক। ভারত ফ্রান্স, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র আমদানি করে, যেখানে পাকিস্তান মূলত চীনের উপর নির্ভরশীল।
বাজেটে বিশাল পার্থক্য, আধুনিকীকরণে এগিয়ে ভারত
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৭৪ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে। বিপরীতে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেট মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল পার্থক্য ভারতের সামরিক আধুনিকীকরণ ও অস্ত্র সংগ্রহে বড় ধরনের সুবিধা এনে দিয়েছে।
ভারতের হাতে রয়েছে ফ্রান্স থেকে কেনা অত্যাধুনিক রাফালে যুদ্ধবিমান, নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি তেজস, রাশিয়ার সুখোই-৩০এমকেআই, এবং দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অগ্নি সিরিজ। পাকিস্তানের বিমানবাহিনীতে রয়েছে মূলত চীন-পাকিস্তান যৌথভাবে তৈরি JF-17 এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত F-16। তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই প্ল্যাটফর্মগুলো ভারতের বিমানের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা।
স্থল ও নৌ শক্তিতে ভারত এগিয়ে, স্থল বাহিনীতে ভারতের সক্রিয় সদস্য প্রায় ১৪ লক্ষ এবং রিজার্ভ ২১ লক্ষ। ট্যাংক রয়েছে প্রায় ৪,৭০০টি এবং আর্টিলারি ১০,০০০+। পাকিস্তানের স্থল বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা ৬.৫ লক্ষ, রিজার্ভ ৫ লক্ষ, ট্যাংক ৩,৭০০ এবং আর্টিলারি ৫,৫০০টি।
নৌ বাহিনীতে ভারতের আছে দুটি বিমানবাহী রণতরী (আইএনএস বিক্রমাদিত্য ও আইএনএস বিক্রান্ত), পারমাণবিক সাবমেরিনসহ মোট ১৫০টির বেশি যুদ্ধজাহাজ। পাকিস্তানের নৌবাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট; নেই বিমানবাহী রণতরী, রয়েছে ৮টি সাবমেরিন ও ৫০টির মতো যুদ্ধজাহাজ।
সমুদ্রে স্পষ্ট আধিপত্য ভারতের
নৌ শক্তির দিক দিয়েও ভারত অনেকটা এগিয়ে। ভারতের হাতে রয়েছে দুটি বিমানবাহী রণতরী—আইএনএস বিক্রমাদিত্য ও আইএনএস বিক্রান্ত, যা পাকিস্তানের কাছে নেই। পাশাপাশি ভারতের সাবমেরিন বহরে পারমাণবিক সাবমেরিন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানের নৌবাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট এবং কম সক্ষম।
পারমাণবিক ক্ষমতায় ভারসাম্য
উভয় দেশের কাছেই রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। ধারণা করা হয়, ভারতের হাতে ১৬০–১৭০টি ওয়ারহেড এবং পাকিস্তানের হাতে ১৬৫–১৭৫টি ওয়ারহেড রয়েছে। তবে কৌশলগত নীতিতে ভিন্নতা আছে: ভারত ‘No First Use’ নীতিতে অটল, যেখানে পাকিস্তান ঘোষণা ছাড়াই প্রথমে ব্যবহারের কৌশল মেনে চলে।
এই পার্থক্য দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও জটিল করে তোলে। বিশেষ করে সীমান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে পরমাণু হুমকিতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মহল।
সাইবার ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে ভারত এগিয়ে
ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা DRDO এবং মহাকাশ সংস্থা ISRO এর মাধ্যমে দেশের সামরিক প্রযুক্তি স্বনির্ভর ও উন্নত হয়েছে। স্যাটেলাইট নজরদারি, ড্রোন ও সাইবার সক্ষমতায় ভারত অনেকটাই এগিয়ে। পাকিস্তান প্রযুক্তিগতভাবে এখনও চীন নির্ভর।
সামরিক শক্তিতে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অনেক এগিয়ে। তবে পরমাণু অস্ত্র এবং সীমান্তে কৌশলগত অবস্থানের কারণে পাকিস্তান সহজ প্রতিপক্ষ নয়। যুদ্ধের পরিবর্তে কূটনৈতিক সংযম ও আন্তর্জাতিক চাপই দুই দেশের উত্তেজনা কমানোর একমাত্র কার্যকর পথ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
আপনার মতামত লিখুন