‘পোস্ট-ইরানিয়ান মিডল ইস্ট’ প্রবন্ধে সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা প্রধান যা লিখেছেন

মনিরুল ইসলাম :
প্রকাশ: ১৭ জুলাই, ২০২৫, ৮:৫৬
‘পোস্ট-ইরানিয়ান মিডল ইস্ট’ প্রবন্ধে সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা প্রধান যা লিখেছেন

মূল প্রবন্ধ ছবি

পাঁচ দশক আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে  দেশ ইসরায়েলের ধ্বংস চায়, তারা পরমাণু অস্ত্র অর্জন করলে তা সহ্য করা হবে না। সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন এবার ঘটল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর মাধ্যমে। ১৩ জুন থেকে শুরু করে প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী অভিযানে ইসরায়েল ব্যাপকভাবে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালায়, যার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইরাক (১৯৮১) এবং সিরিয়া (২০০৭)-তে পরমাণু চুল্লিতে আগেও ইসরায়েল হামলা চালালেও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ছিল তাদের তুলনায় বহু গুণ জটিল ও সুসংহত। এটি ছিল বিস্তৃত, সুদৃঢ়ভাবে সুরক্ষিত, উন্নত প্রযুক্তিতে গঠিত এবং  ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রক্সি শক্তির মাধ্যমে সংরক্ষিত।

এরকম এক জটিল কাঠামোতে সফল অভিযান নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সামরিক কৃতিত্ব।

এই সফলতার পেছনে ইরানের দুর্বলতা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং আসাদ সরকারসহ ইরানের আঞ্চলিক মিত্ররা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। ইরানের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ইসরায়েলি হামলার মুখে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে প্রথমবারের মতো একটি শক্তিশালী, সুরক্ষিত ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা চালায়। এটি ছিল বেগিন নীতির একটি সরাসরি প্রয়োগ, এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নেয়।

অপারেশন রাইজিং লায়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সাধন, একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক চুক্তির পথ প্রশস্ত করা এবং ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ককে দুর্বল করা।

ইসরায়েল চেয়েছিল এই হামলার মাধ্যমে ইরানি সরকারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হোক এবং যুক্তরাষ্ট্র যেন ভবিষ্যতে আরও সক্রিয় ভূমিকা নেয়।

হামলায় ইসরায়েল প্রায় ৮০ শতাংশ ইরানি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে। তারা ২০ জন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং এক ডজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে লক্ষ্য করে সফলভাবে হত্যা করে, যার মধ্যে ছিলেন আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি, ক্ষেপণাস্ত্র কৌশলের নকশাকার আমির আলী হাজিজাদেহ, এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাগেরি।

ইসরায়েলি বাহিনী ১,২০০ এরও বেশি বিমান হামলা চালিয়ে তেহরানসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

ইসরায়েল ৪,০০০-এরও বেশি নির্ভুল গাইডেড বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নাতাঞ্জ, ফরদো, ইসফাহান, আরাকসহ প্রধান পরমাণু স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানে। ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিরোধেও তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। ৯৯.৫ শতাংশ ড্রোন এবং ৮৬ শতাংশ ক্ষেপণাস্ত্র তারা ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়। তবে, ৪০টির মতো ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হানে, যার ফলে ২৯ জন নিহত ও ৩,০০০ জন আহত হয়।

তবে এই সামরিক অভিযানের প্রকৃত মূল্যায়ন এখনো বিতর্কিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। অপরদিকে, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (DIA) একটি ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এই হামলায় ইরানের কর্মসূচি মাত্র কয়েক মাস পিছিয়েছে। এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ বিশ্লেষক একমত ইরানের কর্মসূচি গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ইরান কী করবে? তারা আবারো কূটনৈতিক আলোচনায় ফিরে আসতে পারে, কিংবা গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারে। তারা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে, এমনকি নিউক্লিয়ার নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি (NPT) থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে।

ইরানের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হবে সীমিত সম্পদ কোথায় বরাদ্দ দেওয়া হবে। পরমাণু কর্মসূচি পুনর্গঠন, ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি বৃদ্ধি, আকাশ প্রতিরক্ষা মজবুতকরণ এবং আঞ্চলিক মিত্রদের পুনর্বিন্যাস এই প্রতিটি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রয়োজন।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইরান হয়তো আরও আড়ালে গিয়ে তাদের প্রকল্প চালাবে।

এই পরিস্থিতিতে, কূটনৈতিক সমঝোতাই হতে পারে সবচেয়ে টেকসই সমাধান। যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আলোচনায় বসতে চায়, একটি কঠোর চুক্তির মাধ্যমে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে বাধ্য করতে চায়। সেই সঙ্গে কঠোর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা চালানোর ব্যবস্থাও রাখতে চায়।

ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে, ওয়াশিংটন চায় এমন এক সমঝোতা, যা ভবিষ্যতের ঝুঁকি কমাবে।

এই মুহূর্তে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বিরল এক সুযোগ এসেছে, যেখানে শুধু পরমাণু কর্মসূচিই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন একটি নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনাও সম্ভব হতে পারে।

গাজায় যুদ্ধ শেষ করে, হামাসের নেতৃত্ব নির্বাসনে পাঠিয়ে, সেখানে টেকনোক্র্যাটিক এক ফিলিস্তিনি প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ ছাড়া সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গেও নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির মাধ্যমে হিজবুল্লাহসহ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে নিরপেক্ষ করা সম্ভব হতে পারে।

তবে এর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে সুসংহত কৌশলগত ঐক্য থাকা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে, আর ইসরায়েলকে এই অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আমেরিকা বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মনোনিবেশ করতে পারে।

শেষ পর্যন্ত, জুন মাসের হামলা এক নজির স্থাপন করেছে যেখানে সামরিক শক্তি ও কূটনৈতিক অবস্থানের সমন্বয় ঘটিয়ে একটি পরমাণু কর্মসূচিকে থামানো গেছে। এই অভিযানের দীর্ঘমেয়াদি সফলতা নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক প্রয়াসের ওপর।

যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এই সময়টিকে কাজে লাগাতে পারে, তবে এটি শুধু ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকেই থামাবে না, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কাঠামো পুনর্গঠনের পথ তৈরি করবে।

মূল প্রবন্ধ: অ্যামোস ইয়াডলিন | অনুবাদ: মনিরুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক, নিউজনেক্সট