যৌন আকাঙ্ক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ: স্বাভাবিক চাহিদা না আইনি অপরাধ?

বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রকাশ: ১৭ জুন, ২০২৫, ৮:৪১
যৌন আকাঙ্ক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ: স্বাভাবিক চাহিদা না আইনি অপরাধ?

প্রতীকী ছবি, ইন্টারনেট থেকে।

যৌন আকাঙ্ক্ষা মানুষের স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি। এটি যেমন ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ, তেমনি মানব আচরণের একটি অন্তর্নিহিত ও প্রকৃতিগত অনুভব। তবে এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তির প্রকাশ কখন শালীন ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য, আর কখন তা অন্যের অস্বস্তি বা হয়রানির কারণ হয়ে ওঠে সেই সীমারেখা আমাদের সমাজে এখনও স্পষ্টভাবে নির্ধারিত নয়। ফলে যৌন আকাঙ্ক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ অনেক সময় আইনসঙ্গত ব্যক্তি-অধিকার হিসেবে বিবেচিত হলেও, কখনও তা অপরাধে পরিণত হয় পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে।

বাংলাদেশে সামাজিকভাবে যৌনতা নিয়ে আলোচনা প্রায় নিষিদ্ধ বা চুপচাপে রাখা হয়, ফলে এই বিষয়ে সচেতনতা কিংবা আইনি জ্ঞান উভয়ই বেশ দুর্বল। একদিকে দেখা যায়, কেউ হয়তো আন্তরিক আগ্রহ থেকে একটি প্রস্তাব দিচ্ছেন, কিন্তু অপরপক্ষের অনিচ্ছা বা অস্বস্তি সে ব্যক্তির বিবেচনায় আসছে না। আবার, কেউ কেউ এই প্রাকৃতিক আকাঙ্ক্ষার নামে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ এবং আগ্রাসী ভঙ্গিতে যৌনতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা নিঃসন্দেহে দণ্ডনীয় অপরাধ। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সামাজিক আচরণ এবং আইনি দায়বদ্ধতার এই জটিল সমীকরণ অনেক সময় সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তোলে।

আইন এখানে স্পষ্টভাবে বলে, কাউকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করা বা অঙ্গভঙ্গি, মন্তব্য, শব্দ বা বার্তার মাধ্যমে তার সম্মান বা শালীনতা ক্ষুণ্ণ করা হলে তা যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ কোনও নারীকে উদ্দেশ করে এমন কোনও শব্দ উচ্চারণ করে বা অঙ্গভঙ্গি করে বা এমন কিছু করে যাতে তার শালীনতাবোধে আঘাত লাগে, তাহলে সেই ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। শুধু সরাসরি নয়, ডিজিটাল মাধ্যমেও এই ধরনের আচরণ আইন লঙ্ঘনের শামিল। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা মোবাইল ফোনে কোনও নারীর অনুমতি ছাড়াই যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পাঠালে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

প্রশ্ন হলো, কেবলমাত্র যৌন আকাঙ্ক্ষা বা সম্পর্কের ইচ্ছা প্রকাশই কি অপরাধ? উত্তর হলো- না, যদি তা সম্মতিপূর্ণ হয়, শালীনভাবে উপস্থাপিত হয় এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী উপযুক্ত হয়। দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠা বা আগ্রহ প্রকাশ করা একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু যখন কোনও পক্ষ স্পষ্টভাবে ‘না’ বলছে, কিংবা অস্বস্তি প্রকাশ করছে, তখন সেই ‘না’-কে অগ্রাহ্য করে সম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত দেওয়া, এমনকি তা ভাষাগত হলেও, হয়ে দাঁড়ায় হয়রানি।

এই প্রসঙ্গে কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষাঙ্গনের বাস্তবতা উল্লেখ করা জরুরি। সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য একতরফা হওয়ায় অনেক সময় ঊর্ধ্বতন বা প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে যৌন আগ্রহ প্রকাশ, পরোক্ষ চাহিদা বা ঘনিষ্ঠতার চাপ এক ধরনের নিপীড়নে পরিণত হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় ২০০৯ সাল থেকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা থাকা বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে তা অনেক জায়গায় কার্যকর নয়। ফলে সেখানে যৌন আকাঙ্ক্ষার ‘ইচ্ছা প্রকাশ’ অনেক সময়ই একতরফা চাপ, প্রভাব খাটানো ও নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ধরণের আচরণ আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তরুণ-তরুণীদের ইনবক্সে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন মন্তব্য, ভিডিও ক্লিপ, কুপ্রস্তাব বা অশ্লীল ইমোজি পাঠানো এখন একধরনের ডিজিটাল যৌন সহিংসতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে সাইবার ট্রাইব্যুনালে বহু মামলা হয়েছে যেখানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল মাধ্যমে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে ৩ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, কারো প্রতি আকর্ষণ থাকলে, তার প্রতি ভালো লাগা থাকলে সেটি প্রকাশ করার কী উপায় তাহলে? উত্তরের জন্য প্রয়োজন সামাজিক শিক্ষার প্রসার, সম্মতির সংস্কৃতি ও পারস্পরিক সম্মানের চর্চা। শুধু আইন প্রয়োগই নয়, যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, যৌন শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি এবং নারী-পুরুষ উভয়ের পরস্পরের অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। সমাজ যত বেশি যৌনতা নিয়ে ভয় বা নিষেধের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে, ততই যৌন চাহিদা ও হয়রানির সীমারেখা পরিষ্কার হবে।

অধিকন্তু, ব্যক্তি মাত্রেই তার অনুভব প্রকাশের অধিকার রাখে, তবে সেই অধিকার যেন অন্যের নিরাপত্তা, সম্মান ও স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন না করে, এই ন্যূনতম মানবিক চেতনা যদি প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে তৈরি হয়, তাহলে যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ আর হবে না অপরাধের আশঙ্কা। বরং সমাজে গড়ে উঠবে এমন একটি পরিবেশ, যেখানে সম্পর্ক হবে সম্মতিপূর্ণ, সম্মানজনক এবং নিরাপদ।