রানা প্লাজা: এক যুগের স্মৃতি, বেদনা আর অবহেলার প্রতিচ্ছবি

মনিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল, ২০২৫, ৪:২৪
রানা প্লাজা: এক যুগের স্মৃতি, বেদনা আর অবহেলার প্রতিচ্ছবি

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল—শোক, ক্ষোভ আর রক্তমাখা স্মৃতির দিন; আর পোশাকশিল্পের গায়ে চিরস্থায়ী ক্ষতের দাগ। এদিনে সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে নির্মমভাবে থেমে যায় হাজারো জীবনপ্রদীপ। কেটে গেছে এক যুগ, কিন্তু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া আর্তনাদ এখনো ভেসে আসে সাভারের বাতাসে।

সেদিনের ভয়াবহতায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক। কেউ হারিয়েছেন মা, কেউ ভাই, কেউ সন্তান। এখনও বহু পরিবার নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে বুক ভাসায়, কেউবা ক্ষতিপূরণের আশায় দিন গুনছেন।

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক দীর্ঘ ১২ বছরেও হয়নি মূল দোষীদের বিচার।

জীবিত থেকেও মৃতের মত জীবন

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত ফিরে এলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি বহু শ্রমিক। কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন, কেউ সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ কিডনি রোগে ভুগছেন, কেউ টিউমার নিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়।

গার্মেন্টকর্মী জেসমিন বলছিলেন, দুই দিন ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা ছিলাম। কেউ একজন টেনে বের করেছিলেন। আজও রাতে ঘুমাতে গেলেই সব মনে পড়ে—ছাদ ভেঙে পড়া, আর্তচিৎকার, রক্তের গন্ধ। দোষীদের বিচার দেখে মরতে চাই।

বরিশালের শীলা বেগম বললেন, আমার শরীরটা আর আগের মতো না। কাজ করতে পারি না। মেয়ের স্কুলও বন্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে অপারেশন লাগবে, কিন্তু টাকা কোথায়?

বিচার ও ক্ষতিপূরণ: অচল সিস্টেমের চিহ্ন

বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্ট জানিয়েছে,

  রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের হওয়া ১১টি শ্রম (ফৌজদারি) মামলা এখনও বিচারাধীন। ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে চারটি মামলায় এখনও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাই জারি হয়নি, কিছু মামলায় নোটিশের অপেক্ষা। দায়রা আদালতে বিচারাধীন তিন মামলার মধ্যে একটির কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত।

এদিকে দণ্ডবিধির আওতায় চলমান দুটি মামলায় ৯৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হলেও কবে রায় আসবে, কেউ জানে না। এ যেন এক প্রহসনের বিচার।

স্মৃতি, বেদনা আর অবহেলার প্রতিচ্ছবি

রানা প্লাজার জায়গাটুকু এখন কাঁটাতারবিহীন, খোলা। ভাঙা কংক্রিট ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ বেদি ‘প্রতিবাদ-প্রতিরোধ’ ঘিরে এখনও প্রতিবছর আন্দোলন হয়, স্মরণ হয় নিহতদের।

কিন্তু এক সময়কার শহীদ বেদির আশেপাশে এখন মাদকসেবীদের আড্ডা, দখলদারদের ব্যবসা। স্মৃতি ধুঁকছে, কিন্তু কেউ দেখে না।

সাভারের অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ আজো বয়ে বেড়ায় সেই দিনের বেদনা। সেখানেই একের পর এক লাশ রাখা হতো। সেখানে এসেই বুক চাপড়ে কেঁদেছিলেন কত মা, কত বাবা, কত ভাই-বোন।

শ্রমিকদের দাবি, রাষ্ট্রের দায়

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন,

   ১২ বছরেও আমাদের অনেক দাবি পূরণ হয়নি। অনেক শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পায়নি। সোহেল রানার জব্দকৃত সম্পত্তি থেকে নিহত ও আহতদের পরিবারকে সহায়তা দিন। আর ২৪ এপ্রিলকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করুন।

ব্লাস্টের দাবি, শ্রম আইনে নির্ধারিত ২ লাখ বা আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হাস্যকর। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ পুনঃনির্ধারণ করা হোক। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা, মানসিক পুনর্বাসন এবং স্মৃতিফলক নির্মাণও দাবি করা হয়েছে।

ঘটনা ‘না-ঘটার’ সুযোগ ছিল

ঘটনার একদিন আগেই রানা প্লাজার ৪ ও ৫ তলার পিলারে ফাটল ধরা পড়ে। সংবাদকর্মীরা প্রশাসনকে জানালে তৎকালীন ইউএনও কবির হোসেন সরদার এসে বলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই, প্লাস্টারের ফাটল।’ ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ঘটে গেল দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ ভবন ধসের ঘটনা।

আজও প্রশ্ন জাগে—তৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে হয়তো হারাতে হতো না এতগুলো প্রাণ। রানা প্লাজার কান্না এখনো থামেনি। কেবল থেমে আছে বিচার, থেমে আছে দায়িত্বশীলদের বিবেক।

এই এক যুগে বদলেছে শহর, রাজনীতি, আইন। কিন্তু বদলায়নি নিহত শ্রমিকদের পরিবারের ভাগ্য।

এখনও তারা শুধু শুনে যান, মামলা চলছে, তদন্ত হচ্ছে!