স্মরণ: অভিমানী এক প্রতিভার নাম দাউদ হায়দার

By নিজস্ব প্রতিবেদক

3 Min Read

বাংলা কবিতার ভুবনে দাউদ হায়দার এক ব্যতিক্রমী নাম। ভাষা, চিন্তা, প্রতিবাদ ও আত্মঅভিমানকে এক সুতায় বেঁধে যিনি গড়েছেন এক অনন্য কাব্যজগত। তবে এই কবির পরিচয় শুধু তার কবিতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার রাজনৈতিক বিতাড়ন, নির্বাসনজীবন এবং নিরন্তর আত্মপুঞ্জী একাকিত্বের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সাহসিকতা ও প্রতিবাদের প্রতীক।

শুরুটা ছিল কবিতার প্রেমে

দাউদ হায়দারের জন্ম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, পাবনা শহরে। ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিনেই জন্ম নেওয়া এই কবির চিন্তা ও কলমে ছিল প্রতিবাদের তীব্র সুর। তরুণ বয়সেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন, আর তাঁর কবিতায় উঠে আসতে থাকে সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ও নিষিদ্ধ প্রশ্নের ঝড়।

তার সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত কবিতা “কালো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে” প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে। এতে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামাজিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তিনি যে ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তা তৎকালীন সমাজ ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলে। কবিতাটি প্রকাশের পর দাউদ হায়দারকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নির্বাসনের ট্র্যাজেডি: জন্মভূমি থেকে বহিষ্কার

সাহিত্যিক মতপ্রকাশের অপরাধে তাকে পাঠানো হয় জেলে। তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মুক্তি পেলেও তাকে দেশ ছাড়তে হয়। নির্বাসিত হন জার্মানিতে। সেই শুরু—যার শেষ হয়নি। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তিনি বাস করছেন প্রবাসে, নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে, অথচ মনে প্রাণে লালন করে চলেছেন বাংলাকে।

এ নিয়ে একবার বলেছিলেন—

   আমি দেশ ছাড়িনি, দেশ আমাকে ত্যাগ করেছে

প্রতিবাদী কণ্ঠ, প্রেমিক হৃদয়, দাউদ হায়দারের কবিতায় যেমন প্রতিবাদ আছে, তেমনি রয়েছে প্রেম, গভীর দার্শনিকতা ও একাকিত্বের তীব্রতা। তার লেখনীতে ঘুরেফিরে আসে জন্মভূমির প্রতি গভীর টান, আবার সেই দেশেই নির্বাসনের বেদনা।

তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—

- Advertisement -

প্রতিপক্ষ

স্বদেশ আমার স্বপ্নভূমি

উদ্বাস্তু চৌরাস্তায়

- Advertisement -

উৎসবের নামে হত্যাকাণ্ড

যারা ফিরতে পারে না

কবিতা ১০০ (সম্পাদিত)

পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

দাউদ হায়দার সাহিত্যে অবদানের জন্য দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে তিনি পেয়েছেন জার্মানির ‘ফ্রিডরিশ রুকার্ট পুরস্কার’। এছাড়াও ফ্রান্স, সুইডেন, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে সাহিত্যিক সম্মাননা পেয়েছেন।

কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে কোনো সম্মাননা দেওয়া হয়নি, বরং তার ফেরার পথই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। এ নিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী মহল বারবার উচ্চবাচ্য করলেও রাষ্ট্র ছিল নীরব।

দাউদ হায়দার শুধু একজন কবি নন, তিনি এক আন্দোলন, এক অবিচল প্রতিবাদ। তার কবিতা যেমন বেদনার দলিল, তেমনি আশা ও সাহসের বাতিঘর। জন্মভূমির মাটিতে ফিরতে না পারলেও বাংলা ভাষা, বাংলা কবিতা এবং বাংলার পাঠকের হৃদয়ে তিনি চিরস্থায়ী হয়ে আছেন—এটাই হয়তো একজন কবির সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

উল্লেখ্য, ২৭ এপ্রিল জার্মানিতে বসবাসরত বাংলাদেশের কবি দাউদ হায়দার মৃত্যুবরণ করেন, একই সাথে কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবনের চিরমুক্তি হল।

newsnextbd20
Share This Article
Leave a Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *