অন্ধকার অভিবাসন: বিএমইটির দুর্নীতির জাল, পাচারকৃত নারীর কান্না

পেটের দায়ে, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে স্বপ্নের টানে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন বাংলাদেশের বহু নারী। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে পা দিয়েই সেই স্বপ্ন রূপ নেয় বিভীষিকায়। যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ফেরা কিংবা সদ্যোজাত সন্তান কোলে নিয়ে ফিরে আসা এভাবেই বহু নারী হারাচ্ছেন সম্মান, স্বীকৃতি, এমনকি পরিবারের ঠাঁইও। অথচ তারাই দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের নীরব সৈনিক।
এই ট্র্যাজেডির নেপথ্যে কাজ করছে এক শক্তিশালী মানবপাচার চক্র, যার শেকড় ছড়িয়ে রয়েছে রাষ্ট্রের ভেতরেই—বিশেষ করে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-তে।
অবৈধ নারী অভিবাসনের নামে ভয়াবহ পাচারচক্র গড়ে উঠেছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায়। বিএমইটি-এর ভেতরেই সক্রিয় একটি চক্র জালিয়াতি, বয়স গোপন, প্রশিক্ষণ ছাড়াই ছাড়পত্র প্রদান এবং ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে পাঠাচ্ছে। এদের বড় একটি অংশ মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। অনেকে গর্ভবতী অবস্থায় ফিরছেন, কেউ কেউ সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে ফিরেছেন, আর ফিরেই সমাজ ও পরিবারের কাছেও হচ্ছেন প্রত্যাখ্যাত।
এই পাচারপ্রক্রিয়ার নেতৃত্বে রয়েছেন বিএমইটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মাসুদ রানা। তাঁকে সহায়তা করেন বহির্গমন শাখার পরিচালক মামুন সরদার, অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল হাই এবং মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর। তাদের প্রত্যক্ষ মদদে ৫০টিরও বেশি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রতিনিয়ত গৃহকর্মী পাঠানোর নামে শিশু থেকে শুরু করে অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে আসছে। পাসপোর্ট, বয়সের কাগজপত্র, প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট সবই ভূয়া।
নিয়মবহির্ভূতভাবে শত শত ছাড়পত্র অনুমোদনের মাধ্যমে নারীদের বিদেশে পাঠানোর বিস্তৃত অনিয়মের কেন্দ্রে উঠে আসছে বিএমইটির পরিচালক (প্রবাসী কল্যাণ) মাসুদ রানা ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মামুন সরদারের নাম। দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মাসুদ রানা ও তার সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক ফাইল প্রক্রিয়াগত নিয়ম না মেনে অনুমোদন দেওয়া হয়;
এই সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (আরএল নম্বর: ০৪৬৯)-এর মালিক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এক সময় বিএমইটির মহাপরিচালকের (ডিজি) সঙ্গে বৈঠকেও বক্তব্য দেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাসুদ রানা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তার এই ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানটি অস্বাভাবিক হারে ছাড়পত্র অনুমোদন পেতে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, ৯ মার্চ মোসা. খাতিজা খাতুন নামের এক নারী এইচ এ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ছাড়পত্র পান। তার পাসপোর্ট নম্বর এ০৯০২৪৯৮৬, ভিসা নম্বর ৬১৩৭৬৫২৮০৮ এবং পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর বি০০৩৭৯৮৭৮। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই তথ্য দিয়ে যে পূর্ববর্তী পাসপোর্টটি পাওয়া গেছে, তা অন্য একজন নারীর—যার নাম খাদিজা খাতুন, পিতার নাম মৃত মো. সবির হোসেন মোল্লা এবং মাতার নাম মোসা. রাবেয়া বেগম, ঠিকানা খুলনা। যদিও নতুন পাসপোর্টধারী নারীর পরিচয় সাতক্ষীরা সদরের বাসিন্দা। দুই নারীর বাবার নাম, মায়ের নাম, জন্মতারিখ এবং ছবি—সবই আলাদা।
এমনই আরেক উদাহরণ রাজশাহীর নওগাঁ জেলার মো. পারভিন নামের এক নারী, যিনি ১১ মার্চ সৌদি আরব যাওয়ার ছাড়পত্র পান। তার দেওয়া পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর ইবি০৭৮২১২৬ অনুসন্ধানে ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। এই নম্বর দিয়ে ২০২২ সালে যিনি ছাড়পত্র নিয়েছেন, তার নামও পারভীন হলেও পিতা-মাতা ও জন্মতারিখ ভিন্ন। একইভাবে মানসুরা নামের এক নারী, যার পাসপোর্ট নম্বর এ১৬৮১৩৭৪৯ এবং পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর ইএ০৬৪২৪০৫—এই পুরোনো নম্বরটির কোনো তথ্যই বিএমইটির সার্ভারে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এটি একটি সম্পূর্ণ জাল পাসপোর্ট।
৯ মার্চ লাকি বেগম নামে আরও এক নারী ছাড়পত্র পান, যার পাসপোর্ট নম্বর এ১৭৪১৯৭১৫ এবং পূর্ববর্তী নম্বর বিকে০০৫৯৭৩৩। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ একই নামের ভিন্ন এক নারী এই পাসপোর্ট দিয়ে ছাড়পত্র নিয়েছিলেন। দুই নারীর নাম এক হলেও পিতা, মাতা, জন্মতারিখ ও ছবি—সবকিছুতেই রয়েছে অসঙ্গতি।
১৭ মার্চ এইচ এ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সাফিয়া বেগম নামে এক নারী ছাড়পত্র পান, যার কোনো প্রশিক্ষণ নেই, নেই কোনো প্রত্যাগত পাসপোর্টও। একই দিনে প্রশিক্ষণ ছাড়া ছাড়পত্র পান মোসা. রতনা খাতুন নামের আরেক নারী, যার পাসপোর্ট নম্বর এ১৬০২৭৩২২ ও ভিসা নম্বর ৬১৩৮২০২১৮৩।
এ ধরনের অসংখ্য ভুয়া পাসপোর্ট, জাল নথিপত্র ও অনিয়মের প্রমাণ রয়েছে কালবেলার হাতে—যা প্রমাণ করে, মাসুদ রানা ও তার সিন্ডিকেট বিএমইটি-র দায়িত্বে থেকেই অভিবাসন ব্যবস্থাকে একটি বাণিজ্যিক পাচারপথে রূপ দিয়েছে।
ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নারীদের বিদেশে পাচারের অভিযোগে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কর্মকর্তা ও রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ৩ জুলাই দুদকের সহকারী পরিচালক স্বপন কুমার রায় বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএমইটির উপপরিচালক (বহির্গমন) মো. সাজ্জাদ হোসেন সরকার, সহকারী পরিচালক (বহির্গমন) মো. হোসেন উল্লাহ আকন্দ, জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা মো. নিজামউদ্দিন পাটোয়ারি, এবং অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটর মো. আজাদ হোসেনকে। পাশাপাশি অভিযুক্ত হয়েছেন পাঁচটি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এইচ এ ইন্টারন্যাশনালের ম্যানেজিং পার্টনার আনোয়ার হোসেন, কে এইচ ওভারসিজের সালাউদ্দিন, মক্কা ওভারসিজের জামাল হোসেন, তাসনিম ওভারসিজের আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া, এবং এস এম ম্যানপাওয়ারের পার্টনার একরামুল হক।
তবে বিএমইটির অভ্যন্তরে মামলাটি ঘিরে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, পাচারচক্রের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পরিচিত মাসুদ ও তাঁর প্রভাবশালী সিন্ডিকেট মামলার আওতার বাইরে থেকে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, মাসুদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে স্পর্শ করা হয়নি। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণেই পাচারচক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠাতে গেলে ‘প্রত্যাগত’ কর্মীদের অগ্রাধিকার দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সুযোগকেও জালিয়াতির কাজে লাগায় বিএমইটি-এজেন্সি সিন্ডিকেট। অনেক নারী কখনো বিদেশ যাননি, অথচ তাদের ফাইল ‘প্রত্যাগত’ হিসেবে দেখিয়ে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এমনই এক ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে ‘জোসনা বেগম’ নামধারী এক নারীর ক্ষেত্রে। ওই একই পাসপোর্ট নম্বরের প্রকৃত মালিক রিকশাচালক মজিবর রহমানের স্ত্রী সালমা বেগম, যিনি সৌদি আরবে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। সেই পুরনো পাসপোর্ট নম্বরেই নতুন পরিচয়ে জোসনাকে বিদেশ পাঠানো হয়, অথচ বয়স ও ছবি পুরোপুরি আলাদা।
রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে জুন মাত্র চার মাসে শত শত নারীকে একইভাবে জাল তথ্য ব্যবহার করে বিদেশ পাঠানো হয়। এগুলোর বেশির ভাগই অনুমোদন পেয়েছে মাসুদ রানা ও মামুন সরদারের স্বাক্ষরে। এক সময় একই শাখায় তিনজন পরিচালক নিয়োগ দিয়ে দায়িত্ব ভাগাভাগির নামে রিক্রুটিং এজেন্সিদের চাপে নিয়ম ভাঙা হয়। মূলত এভাবেই শত শত ফাইল অদৃশ্যভাবে অনুমোদিত হয়। শুধু এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি এজেন্সিই ৪০০-এর বেশি জাল ফাইল অনুমোদনের সুবিধা নেয়।
ওকাপ-এর তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অন্তত ৫ হাজার নারী তাদের কাছে সহায়তা চেয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা, কেউ ফিরেছেন সদ্যজাত সন্তান নিয়ে। ৪০ জন ছিলেন শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ। আইনি সহায়তা নিতে হয়েছে অন্তত ৪৬ জনকে। কেউ কেউ জানান, তারা বিদেশে গিয়েই প্রথম জানতে পারেন তাদের কাজ হবে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা, বিনা পারিশ্রমিকে। নৈতিক ও সামাজিক নিপীড়ন এত বেশি যে অনেকেই আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এটি একটি কাঠামোগত পাচার ব্যবস্থা, যার ভেতরে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা জড়িত।
মানবাধিকার কর্মী তানিয়া আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশ থেকে নারীর অভিবাসন এখন আর কেবল অর্থনৈতিক প্রেরণায় গঠিত একটি প্রক্রিয়া নয়, বরং তা রূপ নিচ্ছে এক করুণ মানবিক সংকটে। তাঁর ভাষায়, এই সংকটের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং চূড়ান্ত দায়হীনতা। যে পথ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে, সেই পথেই আজ গড়ে উঠছে শোষণ ও পাচারের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক।
তানিয়া আহমেদ সতর্ক করেন, এই চক্রের হোতাদের দ্রুত আইনের আওতায় না আনলে অভিবাসনপথ নারীর জন্য হয়ে উঠবে আরও বিপজ্জনক এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে বিএমইটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মাসুদ রানার সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি। পরে লিখিতভাবে প্রশ্ন পাঠিয়ে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
উল্লেখ্য, গত মার্চে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-তে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু নিয়ে দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য ভয়াবহ রূপ নেয়। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ ছাড়া কোনো বৈধ ফাইলই প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে না। হঠাৎ করে ম্যানুয়াল ফাইল গ্রহণ বন্ধ করায় হাজারো সৌদিগামী কর্মী বিপাকে পড়েন, বহু ফ্লাইট বাতিল হয়।
এই অচলাবস্থার প্রতিবাদে শতাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি ডিজির কার্যালয় ঘেরাও করে ইমিগ্রেশন পরিচালক মামুন মিয়ার অপসারণ দাবি করে। বায়রার নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিএমইটির ডিজি অনিয়ম তদন্তের আশ্বাস দেন। সিদ্ধান্ত হয়, ২৮ ফেব্রুয়ারির আগের ভিসা-ওকালায় সত্যায়ন ছাড়া ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হবে এবং আবেদন চলবে অনলাইন-অফলাইনে।
আপনার মতামত লিখুন