অভ্যুত্থানের এক বছর: উত্তরণের পথ খুঁজছে বাংলাদেশ

এক বছর আগে আজকের এই দিনে, প্রবল ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে অবসান ঘটে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনের। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সূচিত সেই ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই রূপ নেয় সার্বজনীন গণআন্দোলনে, যা ইতিহাসে জায়গা করে নেয় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে।
সরকার পতনের দিনটি—৫ আগস্ট—বর্তমানে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দিনটি স্মরণে চলছে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালা, যার সমাপ্তি ঘটবে আজ সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠের মধ্য দিয়ে। এটি উপস্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
হাসিনা সরকারের পতন: এক নজরে ঘটনা প্রবাহ
২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, এসব নির্বাচন ছিল অনিয়মপূর্ণ—২০১৪ সালে একতরফা, ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে ‘ডামি নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হতে থাকে।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ফের সক্রিয় হয় কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা নতুন মোড় নেয় ২০২৪ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের রায়ের পর। রায় অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল থাকায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশের শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলন’ নামে এক প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত হয়ে ছাত্ররা সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়।
শেখ হাসিনার কিছু বিতর্কিত বক্তব্য, মন্ত্রীদের হুমকি, এবং ছাত্রলীগ-পুলিশের সহিংসতায় নিহতের ঘটনাগুলো আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৬ জুলাই, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর দেশজুড়ে ক্ষোভ আরও তীব্র হয়।
এর পরবর্তী দিনগুলোতে কারফিউ, সেনা মোতায়েন, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, গণগ্রেপ্তার—সব মিলিয়ে এক রকম ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ বিরাজ করে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে। সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ জুলাই শোক পালনের ডাক দেওয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীরা ‘লাল কাপড় বেঁধে’ প্রতীকী প্রতিবাদে অংশ নেন। একই দিনে শিক্ষক, অভিভাবক ও নাগরিক সমাজও রাজপথে যোগ দেন।
সরকারের পতন: ৫ আগস্ট
বিক্ষোভের উত্তাপ যখন চূড়ান্তে, তখন ১ আগস্ট সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে। ২ আগস্ট লাখো মানুষের ‘দ্রোহযাত্রা’ শুরুর পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনকারীদের একতফা আহ্বানে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী। একদিন পর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে।
৫ আগস্ট সকাল থেকেই শুরু হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’। কারফিউ উপেক্ষা করে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকেন মানুষ। রাজধানীর শাহবাগ, সংসদ ভবন ও গণভবন চত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
অবশেষে পরিস্থিতি অনুকূলে না দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক বিমানে দেশ ত্যাগ করেন। এএফপির তথ্যমতে, তিনি ভারত গমন করেন। পদত্যাগপূর্ব ভাষণ রেকর্ড করারও সুযোগ পাননি বলে জানানো হয়।
শহীদ সংখ্যা ও পালিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে
সরকারি গেজেট অনুযায়ী, অভ্যুত্থানকালে ৮৩৬ জন নিহত হন। বিএনপি দাবি করেছে, তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শহীদের সংখ্যা অন্তত ৪২২ জন।
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে আজ দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় মোনাজাত ও প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে আজ বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে ‘যাত্রাবাড়িতে গণহত্যা’ শীর্ষক জুলাই-২৪ পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠান।
নতুন বাঁকে বাংলাদেশ
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে চলছে এক নতুন বাঁকবদল। মাসব্যাপী ‘জুলাই পুনর্জাগরণ’ কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।
আজকের এই দিনে দেশ স্মরণ করছে সেই ঐতিহাসিক গণজাগরণকে, যেটি শুধু একটি সরকার নয়, একটি প্রজন্মের আত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ হয়ে উঠেছিল।
আপনার মতামত লিখুন