আশুরা ও কারবালা: ত্যাগ, সত্য ও সাহসিকতার চিরন্তন প্রতীক

ইসলামের ইতিহাসে আশুরা এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দিন। আরবি ‘আশুরা’ শব্দের অর্থ দশম, যা হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের দশম দিনকে বোঝায়। এই দিনটি শুধু কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার কারণে নয়, সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই নানা ঐশী ঘটনার সাক্ষী হিসেবে পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহর কাছে সম্মানিত ১২ মাসের মধ্যে চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। মহররম সেই চার সম্মানিত মাসের একটি। এই মাসেই ঘটে যায় কারবালার হৃদয়বিদারক অধ্যায়, যা আশুরাকে শোক, ত্যাগ ও আদর্শের প্রতীকে রূপান্তর করে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আশুরার দিনে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। এ দিনে হজরত আদম (আ.) সৃষ্টি হন, হজরত নূহ (আ.) তার কিশতিসহ জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন, ফেরাউন নীলনদে ডুবে যায়, হজরত মুসা (আ.) মুক্তি লাভ করেন, হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান, হজরত ঈসা (আ.) আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এসব ঘটনাই আশুরাকে এক পবিত্র দিনে রূপ দিয়েছে।
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় আশুরার সবচেয়ে বেদনাবিধুর ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ঘটে ৬১ হিজরির এই দিনেই—কারবালার প্রান্তরে। সেখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থেকে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি স্বপরিবারে ইয়াজিদের জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আত্মত্যাগের এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, যা আজও বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে জেগে থাকে।
কারবালার প্রেক্ষাপট জটিল হলেও মূলত একটি কথাই স্পষ্ট—ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামের মূল আদর্শ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, যেখানে ন্যায়, সত্য ও নৈতিকতার কোনো বিকল্প নেই। মদিনার মানুষ ও কুফাবাসীর আহ্বানে তিনি রওনা হন কুফার দিকে, কিন্তু পথে ইয়াজিদের নিযুক্ত গভর্নর ইবনে জিয়াদ তাকে বাধা দেয়। কুফার মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় এক সময় তিনি পরিবারসহ বন্দি হয়ে পড়েন কারবালার তপ্ত বালুর প্রান্তরে।
তাদের খাদ্য ও পানি বন্ধ করে দিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে নিঃসঙ্গ করে ফেলা হয়। তাঁর প্রিয়জনদের একে একে শহীদ করা হয়। তারপর আশুরার দিন, যুদ্ধের এক নিষ্ঠুর ঘূর্ণাবর্তে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এক কাপুরুষ সৈন্য তাঁর পবিত্র মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। তার রক্তে রঞ্জিত হয় কারবালার মাটি।
ইয়াজিদের বাহিনী হয়তো সাময়িকভাবে জয় পেয়েছিল, কিন্তু ইতিহাসের চোখে প্রকৃত বিজয়ী ছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.)। কারণ, তিনি ছিলেন সত্যের প্রতিনিধি। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। কারবালা আমাদের শিখিয়ে দেয়, জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ঈমানের দাবী; আর আত্মত্যাগই পারে ইতিহাস বদলে দিতে।
কারবালা শুধু এক ট্র্যাজেডি নয়, এটি ইসলামের চেতনাকে উদ্দীপ্ত রাখার এক অনন্ত অনুপ্রেরণা। হোসাইনের আত্মত্যাগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—সত্য, ন্যায় ও মানবতার পথ কখনো মসৃণ নয়, তবে সেই পথই শ্রেষ্ঠ ও চিরজীবী।
আপনার মতামত লিখুন