কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ (এলও) অফিসে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট ভুয়া খতিয়ান, রোয়েদাদ ও চলমান মামলার তোয়াক্কা না করে সরকারের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এই জালিয়াতিতে ভূমি অধিগ্রহণ অফিসের কর্মকর্তা, সার্ভেয়ার এবং দালালদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ৬ মে ২০২৫ তারিখে এলও অফিসের ২ নম্বর শাখা থেকে মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া মৌজার ৮৮৬ নং খতিয়ানের ২ একর ৭৭ শতক জমির বিপরীতে ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ উত্তোলন করা হয় (এলও মামলা নং ৩/১৮-১৯)। তবে বিস্ময়করভাবে জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও এই টাকা পরিশোধ করা হয়।
তথ্য অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই জালিয়াতির মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন দালাল মামুনুর রশিদ ওরফে ‘চশমা মামুন’, এলও-২ শাখার অফিস সহকারী ফাওয়াজ মোহাম্মদ রিমন এবং সার্ভেয়ার বাকীরুল ইসলাম। দালাল মামুন একাই প্রায় ২৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতা তারেক চেয়ারম্যান ও তার বড় ভাই নোমানের নেতৃত্বে একটি দালাল চক্র এলও অফিসে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। মামুন কক্সবাজারে বিডিআর ক্যাম্প সংলগ্ন চৌধুরীপাড়ায় কোটি টাকার জমি কিনে ভবন নির্মাণ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া, রোয়েদাদ নং ৭/৮/৯/১০ সংক্রান্ত জমির বিষয়ে মহেশখালীর আদালতে মামলা নং অপর-৪৪৭/২০২২ ও অপর-১২৪৫/২০২১ এবং এডিসি (রাজস্ব) আদালতে নামজারি আপিল-১৩১/২০২২ চলমান রয়েছে। অথচ বিএস রেকর্ড অনুযায়ী যাদের নামে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, তাদের নামই খতিয়ানে নেই। এলও অফিসের স্ক্রল অ্যাডভাইস ছাড়াই ওইসব ব্যক্তি টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এলও-২ ও এলও-৩ এর কর্মকর্তা এটিএম আরিফের স্বাক্ষরে স্ক্রল এডভাইস রিলিজ করা হয়, যা তদন্তসাপেক্ষে বিতর্কিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভুক্তভোগী রহমত আলীর ওয়ারিশদের পক্ষে নূর বানু ২৫ মে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কক্সবাজার, জেলা প্রশাসক ও ভূমি অফিসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, মিথ্যা তথ্য ও জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে তাদের প্রাপ্য টাকা উত্তোলন করেছেন মাওলানা শফিউল আলম, আব্দুল মোনায়েম, আবু বক্কর, ইলিয়াস, আবু তাহের, জকরিয়া ও গিয়াস উদ্দিন। তারা সাতটি চেকের মাধ্যমে মোট ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। অভিযোগে আরও বলা হয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও দালাল নোমানের ছত্রছায়ায় এ অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে।
সার্ভেয়ার বাকেরুল ইসলামকে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও তিনি ঘুষ ও প্রভাব খাটিয়ে আবারও কক্সবাজার এলও অফিসে ফিরে আসেন। ২০২৪ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় তাকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ করলেও তিনি এখনও স্বপদে বহাল রয়েছেন। ২০২৫ সালের ২৫ এপ্রিল বিভাগীয় কমিশনারের আদেশে পুনরায় স্ট্যান্ড রিলিজ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ২৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট খতিয়ানের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উভয় পক্ষ তাদের কাগজপত্র জমা দেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ ছাড়াই ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান করা হয়। এমনকি শুনানির সময় সার্ভেয়ার নিজে কোনো চেক ইস্যু হয়নি বলে জানালেও পরে দেখা যায়, রোয়েদাদ বহিতে তড়িঘড়ি করে সংশোধনী আনা হয়েছে, যার কোথাও কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই।
এই জালিয়াতি প্রকাশ্যে আসার পর জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, “আমরা এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি এবং তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি চলমান মামলা থাকাকালীন ক্ষতিপূরণের চেক ইস্যু করা হয়ে থাকে, তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এ ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ ফেরত আনা এবং ভূমি অফিসে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
আপনার মতামত লিখুন