জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় ঢাকায়: প্রশ্ন, উদ্বেগ ও লুকোচুরি

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের (OHCHR) একটি কার্যালয় ঢাকায় স্থাপনের খবরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার ঝড় উঠেছে। যদিও সরকার বলছে এটি শুধুই কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণভিত্তিক একটি উদ্যোগ, তবে এর সময়, প্রক্রিয়া এবং গোপনীয়তা ঘিরে জনমনে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষত, যখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আন্তর্জাতিক করিডোর ইস্যু এবং মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বিদ্যমান, তখন এই কার্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনের উদ্দেশ্য, এখতিয়ার এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে নানা মহলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও জল্পনা-কল্পনার জন্ম নিয়েছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে করিডোর ইস্যুতে বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) একটি কার্যালয় স্থাপনের বিষয়টি নতুন করে আলোচনা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
চলতি মাসেই জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের মধ্যে এই কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হয়েছে বলে জানানো হলেও, কখন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার নির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও চুক্তির তারিখ নেই, যা স্বাভাবিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২৪ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থেই এই কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রয়োজনে ছয় মাসের নোটিশে এটি প্রত্যাহার করা যাবে।
অথচ মাসের শুরুতেই একই প্রশ্নে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে কি না, তা আমি বিচার করতে চাই না।
একই উপদেষ্টার এমন ভিন্নমুখী বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এছাড়া, ১৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, কার্যালয়টির উদ্দেশ্য মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে সহায়তা করা। তবে কবে MoU সই হলো বা কেন এটি গোপন রাখা হলো, তা বিবৃতিতে নেই।
কেন বিতর্ক?
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বা ইউনিসেফের মতো সংস্থাগুলোর অফিস দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে থাকলেও কখনো তেমন বিতর্ক তৈরি হয়নি। কিন্তু মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের অফিস নিয়ে শঙ্কা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় সাধারণত যুদ্ধবিধ্বস্ত, সংঘাতপূর্ণ বা গৃহযুদ্ধ কবলিত দেশগুলোতেই স্থাপিত হয়। ফলে প্রশ্ন উঠছে, জাতিসংঘ কি বাংলাদেশকে ওই শ্রেণিভুক্ত দেশ হিসেবে দেখছে? না কি তারা মনে করছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আগামী দিনে আরও জটিল হবে?
কিছু মহল থেকে বলা হচ্ছে, এই কার্যালয় মুসলিম মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পশ্চিমা মানবাধিকার চর্চার জায়গা হতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, “জুজুর ভয়” থেকেই এ নিয়ে অতিরিক্ত শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন
এই কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে প্রথমবার সংবাদমাধ্যমে খবর আসে জাতিসংঘের এক বিবৃতির মাধ্যমে। কিন্তু এর আগে বা পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। বরং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিবৃতি আসে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরপরই। সচরাচর যে কোনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই বক্তব্য দেয় বা নেতৃত্বে থাকে, এই ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হওয়াও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিসংঘের সঙ্গে সই হওয়া এই সমঝোতা স্মারকে কী শর্তাবলি রয়েছে, তা জনসমক্ষে এখনো উন্মুক্ত করা হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, যদি MoU-টি গোপন রাখা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ আরও গভীর হবে।
রাজনৈতিক পরামর্শ না নিয়েই সিদ্ধান্ত?
যেহেতু এটি একটি নীতিগত ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অথচ তা হয়নি। অনেকেই মনে করছেন, জাতিসংঘ দ্রুত এই কার্যালয় খুলতে চেয়েছে কারণ তারা আশঙ্কা করছিল, একটি নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তিতে যেতে না-ও পারে।
স্বার্থ না চাপ?
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের এই কার্যালয় স্থাপন একদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর সদস্যপদ, জিএসপি সুবিধা ও মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার কৌশলের অংশ হতে পারে। আবার অন্যদিকে এটি হতে পারে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি সরাসরি ঢাকায় বসে পর্যবেক্ষণের একটি করিডোর, যেহেতু মিয়ানমার সরকার জাতিসংঘকে সেখানে ঢুকতে দিতে চায় না।
এখতিয়ার কতটুকু?
এই কার্যালয় কি শুধু প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তার মধ্যেই সীমিত থাকবে, নাকি এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সরাসরি তদন্তের কাজেও যুক্ত হতে পারবে? এমন প্রশ্নও রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী যেমন র্যাব, ডিবি বা সামরিক গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ আসে, তাহলে জাতিসংঘের এই অফিস তাদের বিরুদ্ধেও কি তদন্ত চালাতে পারবে? এমন প্রশ্নে অনেকেই দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন।
জনমনে থাকা আরও কিছু প্রশ্ন
১. জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যত অচল থাকা অবস্থায় জাতিসংঘের কার্যালয় খোলার অর্থ কী?
২. এ সিদ্ধান্ত কি জাতিসংঘের ‘বেস্ট প্র্যাকটিস’ প্রয়োগের পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার?
৩. চুক্তিটি কি সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদের অধীন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়েছে এবং সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে?
৪. অন্তর্বর্তী সরকার কি এই ধরনের চুক্তি করার সাংবিধানিক অধিকার রাখে?
সিনিয়র সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যতো দ্রুত সম্ভব চুক্তির পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ করা হলে অনেক বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে। নতুবা লুকোচুরি বা অস্পষ্ট বার্তার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তকে ঘিরে জনমনে শঙ্কা ও সন্দেহ আরও বাড়বে।
আপনার মতামত লিখুন