দুবাইয়ের আকাশছোঁয়া ভবনে লুকানো বাংলাদেশের পাচার হওয়া অর্থ

দুবাইয়ের ঝলমলে আকাশচুম্বী দালান, বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট, আর সমুদ্রপাড়ের মনোরম ভিলা—সব যেন স্বপ্নের মতো। কিন্তু এই স্বপ্নের আড়ালে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের কালো টাকা সাদা করার এক বাস্তব ও কুৎসিত অধ্যায়।
সুইস ব্যাংক, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ায় টাকা পাচারের কথা শোনা গেছে আগেও। কিন্তু সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এক নতুন গন্তব্যের নাম—দুবাই। এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, শুধু বিলাসী জীবন নয়, সেখানে বাংলাদেশিদের এক ‘সুপ্ত সাম্রাজ্য’ গড়ে উঠেছে—যার ভিত গড়া হয়েছে এই দেশেরই সম্পদ চুরি করে।
গোল্ডেন ভিসার স্বর্গে ‘স্বর্ণালী’ বিনিয়োগ
২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত চালু করল ‘গোল্ডেন ভিসা’ কর্মসূচি। মাত্র ২ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ থাকলেই মিলবে দীর্ঘমেয়াদি আবাসনের অনুমতি। এই সুযোগটা লুফে নেয় বাংলাদেশি বিত্তশালী ও প্রভাবশালীরা। রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ঠিকাদার, ব্যাংক পরিচালক, ব্যবসায়ী—তালিকা দীর্ঘ।
তারা কেউ সপরিবারে চলে গেছেন, কেউ দেশে থেকে অর্থ পাচার করে সেখানে প্রপার্টি কিনেছেন। অভিযোগ আছে, কেউ কেউ আবার রীতিমতো ব্যবসার ছত্রছায়ায় প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে গড়েছেন ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য।
৯৭২টি প্রপার্টি, ৪৫৯ জন বাংলাদেশি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা C4ADS এবং ইউরোপিয়ান ট্যাক্স ওয়ার্চডগ EU Tax Observatory-এর তথ্য বলছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত অন্তত ৪৫৯ জন বাংলাদেশি দুবাইয়ে মোট ৯৭২টি সম্পত্তি কিনেছেন। আনুমানিক মূল্য—৩১.৫ কোটি মার্কিন ডলার। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত পরিমাণ এর কয়েকগুণ বেশি।
এনবিআরের দরজায় দুদক
এখনো পর্যন্ত এই পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানটি তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করে এরইমধ্যে ৭০ জন পাচারকারীর তালিকা এনবিআরে পাঠিয়েছে। টিন নম্বর, আয়কর রিটার্ন, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সব ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে।
তালিকায় নাম রয়েছে বহু পরিচিত মুখের—রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী এমনকি শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিদেরও।
তালিকায় যাদের নাম রয়েছেন, তারা হলেন-
আহসানুল করীম, আনজুমান আরা শহীদ, হেফজুল বারী মোহাম্মদ ইকবাল, হুমায়রা সেলিম, জুরান চন্দ্র ভৌমিক, মো. রাব্বী খান, মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ অলিউর রহমান, এস এ খান ইখতেখারুজ্জামান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সৈয়দ ফাহিম আহমেদ, সৈয়দ হাসনাইন, সৈয়দ মাহমুদুল হক, সৈয়দ রুহুল হক, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া, হাজী মোস্তফা ভূঁইয়া, মনজ কান্তি পাল, মো. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, মো. মাহবুবুল হক সরকার, মো. সেলিম রেজা, মোহাম্মদ ইলিয়াস বজলুর রহমান, এস ইউ আহমেদ, শেহতাজ মুন্সী খান, এ কে এম ফজলুর রহমান, আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ, চৌধুরী নাফিজ সারাফাত, গুলজার আলম চৌধুরী, হাসান আশিক তাইমুর ইসলাম, হাসান রেজা মহিদুল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ। এম সাজ্জাদ আলম, মোহাম্মদ ইয়াসিন আলী, মোস্তফা আমির ফয়সাল, রিফাত আলী ভূঁইয়া, সালিমুল হক ঈসা বা হাকিম মোহাম্মদ ঈসা, সৈয়দ এ কে আনোয়ারুজ্জামান বা সৈয়দ কামরুজ্জামান, সৈয়দ সালমান মাসুদ, সৈয়দ সাইমুল হক, আবদুল হাই সরকার, আহমেদ সামীর পাশা, ফাহমিদা শবনম চৈতি, মো. আবুল কালাম, ফাতেমা বেগম কামাল, মোহাম্মদ আল রুমান খান, মায়নুল হক সিদ্দিকী, মুনিয়া আওয়ান, সাদিক হোসেন মো. শাকিল, আবদুল্লাহ মামুন মারুফ, মোহাম্মদ আরমান হোসেন, মোহাম্মদ শওকত হোসেন সিদ্দিকী, মোস্তফা জামাল নাসের, আহমেদ ইমরান চৌধুরী, বিল্লাল হোসেন, এম এ হাশেম, মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন চৌধুরী, নাতাশা নূর মুমু, সৈয়দ মিজান মোহাম্মদ আবু হানিফ সিদ্দিকী, সায়েদা দুররাক সিনদা জারা, আহমেদ ইফজাল চৌধুরী, ফারহানা মোনেম, ফারজানা আনজুম খান, কে এইচ মশিউর রহমান, এম এ সালাম, মো. আলী হোসেন, মোহাম্মদ ইমদাদুল হক ভরসা, মোহাম্মদ ইমরান, মোহাম্মদ রোহেন কবীর, মনজিলা মোর্শেদ, মোহাম্মদ সানাউল্যাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ সরফুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
বাংলাদেশের টাকায় বিদেশের বিকাশ
এই অর্থপাচার শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীকও। যারা দেশের উন্নয়নের কথা বলেন, গণমানুষের ভাগ্য ফেরানোর অঙ্গীকার করেন, তারাই অন্যায়ভাবে অর্থ নিয়ে গড়েছেন দুবাইয়ে অভিজাত জীবন।
দুর্নীতি বিশ্লেষকদের মতে, বিষয়টি কেবল দেশ থেকে পুঁজি পাচারের প্রশ্ন নয়; বরং তা দেশের আইন-শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা, এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বড় ধরনের হুমকি।
শেষ কথা
দুবাইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই বাংলাদেশিদের প্রপার্টি কেবল বিলাসবহুল আবাসন নয়—তা আমাদের রাষ্ট্রের দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোর, শিথিল নজরদারির এবং বিচারহীনতারও প্রতিফলন। এই অনুসন্ধান হয়তো সেই আড়াল ভেদ করে কিছু আলোর মুখ দেখাবে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই ৯৭২টি প্রপার্টির প্রকৃত মূল্য কত? আর দেশের কত টাকা এখনো দেশের বাইরে গচ্ছিত রয়েছে এমন অজানা কোন ‘সেফ হ্যাভেন’-এ?
আপনার মতামত লিখুন