প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে কোটি টাকার লুটপাট, অভিযোগের কেন্দ্রে কৃষিবিদ গোলাম রব্বানী

বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রকাশ: ১২ জুলাই, ২০২৫, ৬:৫১
প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে কোটি টাকার লুটপাট, অভিযোগের কেন্দ্রে কৃষিবিদ গোলাম রব্বানী

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে’ (এলডিডিপি) দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। পাঁচ বছর মেয়াদি ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে কৃষিবিদ গোলাম রব্বানীর নাম, যিনি ছিলেন প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (সিটিসি)। প্রশাসন ক্যাডারের প্রকল্প পরিচালক থাকলেও প্রকল্পটির নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত এই আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তার হাতে।

২০১৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি দেশের পার্বত্য তিন জেলা ছাড়া সব জেলা-উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে চালু হয়। লক্ষ্য ছিল প্রানিজ খাদ্য উৎপাদন, গবাদি পশুর সংখ্যা ও মান বৃদ্ধিসহ জলবায়ু-সহনশীল খামার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বাস্তবতায় এসবের চেয়ে প্রকল্পটি পরিণত হয় লুটপাটের প্ল্যাটফর্মে।

মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য ট্যাব কেনার কার্যাদেশ দেয়া হয় গোলাম রব্বানীর ঘনিষ্ঠ একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে। নিম্নমানের ওইসব ট্যাব বাজারদরের কয়েকগুণ বেশি দামে কেনা হয়। অধিকাংশ ট্যাব এখন অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। এর মধ্য দিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ হয় বলে অভিযোগ।

একইভাবে ডিজাইন ফার্ম নিয়োগ, স্লটার হাউজ নির্মাণ, পশুখাদ্য ক্রয়, ভ্যাকসিন কেনাসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়মের ছাপ স্পষ্ট। সরকার নির্ধারিত ৩৮ টাকা কেজির খাদ্য ৭২ টাকায় কেনা হয়। ফিড ও ভ্যাকসিন ক্রয়ের সময় ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়াও মানা হয়নি। অথচ একই এফএমডি ভ্যাকসিন আরেক প্রকল্পের আওতায় আগেই কেনা হয়েছিল।

প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের দরপত্রে নিয়ম ভেঙে একক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া, পছন্দের ঠিকাদারদের রেসপন্সিভ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার কার্যাদেশ, একই ধরনের পণ্য আলাদা প্যাকেজে ভাগ করে অনুমোদন এড়িয়ে কাজ দেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে— প্যাকেজ জি-৬৬, জি-৭০, জি-৮০, জি-১২১, জি-৪২, ডি-৬২, জি-১৫, জি-৯৮, জি-৯৯, জি-৬২, জি-৬৬ (২)–সব ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট লোককে সুবিধা দিতে দরপত্র প্রক্রিয়া সাজানো হয়। কিছু পণ্য অনুপযোগী, কিছু সরবরাহই হয়নি।

ঘাসচাষ, রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি খাতেও বরাদ্দ হয়েছে অপ্রয়োজনীয় কোটি কোটি টাকা, যদিও এসব খাত আগে থেকেই রাজস্ব বাজেটের আওতায় ছিল। এলডিডিপি ঘাস চাষের কোনো বাস্তব প্রমাণও পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, এসব বরাদ্দ থেকে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ পর্যন্ত কমিশন নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এলজিইডি থেকে আসা প্রকৌশলীকেও কোনো কমিটিতে রাখা হয়নি।

দুর্নীতির আরেক নজির হলো প্রকল্পের ৯০ শতাংশ ম্যাচিং গ্রান্ট শুধুমাত্র রংপুর অঞ্চলে বিতরণ। সরকারি নীতিমালার পুরোপুরি লঙ্ঘন করে আঞ্চলিক পক্ষপাত দেখিয়েছেন সিটিসি গোলাম রব্বানী। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের নিয়োগেও দেখা গেছে পক্ষপাত; রংপুরের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার, আত্মীয় নিয়োগ, অনুপস্থিত থেকেও বেতন উত্তোলন—সবই তার ছত্রছায়ায় ঘটেছে।

প্রকল্পের অর্থে গোলাম রব্বানী চারবার ইউরোপ সফর করেছেন, স্থানীয় প্রশিক্ষণের নামে খরচ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ছাতা, লাঠি, চেয়ার কেনার নামে প্রতিবছর বিল দেখানো হয়েছে ১৮-২০ লাখ টাকা, যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমনকি স্কুল মিল্ক কর্মসূচিতে বাজারদরের চেয়ে দুই টাকা বেশি দামে দুধ কেনার নেপথ্যেও তার ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রকল্পের শেষ সময়ে এসে নতুন করে পিপিআর ভ্যাকসিন, স্কুল ফিডিং, পশুখাদ্য ও যন্ত্রপাতি কেনার নামে কয়েকটি ভুয়া আইটেম সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়। এসব দুর্নীতির বিষয়ে একাধিক সূত্র, নথিপত্র ও কর্মকর্তাদের বক্তব্যে মিল পাওয়া গেলেও, অভিযুক্ত গোলাম রব্বানী এখনো রাজধানীতে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

এই সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলেও গোলাম রব্বানীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।