ভাইরাল বাবুল চাখারী: কে তিনি, কী বলছেন চাখারের মানুষজন?

এমপি পরিচয় দিয়ে গ্রেপ্তার বাবুল চাখারী (মে ১৬, ২০১৮) - ছবি : সংগৃহীত
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রতিক ভাইরাল ভিডিওকে কেন্দ্র করে ফের বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী। ১৮ জুন আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, এই সরকার স্বৈরাচার সরকার। আন্দোলন করার পরও যদি আমাকে জেল খাটতে হয়, ৮ মাস জেল খেটেছি এই সরকারের অত্যাচারে। মুহূর্তেই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে এটি একমাত্র ভিডিও নয়, ভাইরাল হওয়ার পর খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে কটাক্ষ করে দেওয়া বাবুল চাখারীর আগের একটি বক্তব্যও ভাইরাল হয়ে যায়। এর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় নতুন করে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়।
তবে এ বিতর্ক তাঁর জীবনে প্রথম নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতারণা, ভুয়া পরিচয় ব্যবহার এবং রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ২০১৮ সালের ১৬ মে, যখন নিজেকে বরিশালের সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য পরিচয় দিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যানের কাছে পাঁচ কোটি টাকার একটি কোম্পানির বকেয়া বিল মওকুফের তদবির করতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়েন তিনি।
সূত্র জানায়, বাবুল সরদারের স্থায়ী ঠিকানা বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার মাদারকাঠী গ্রামে। যদিও তিনি নিজেকে ‘চাখারী’ পরিচয়ে তুলে ধরেন, যা স্থানীয়রা অস্বীকার করেছেন, বাবুলের বাড়ি মাদারকাঠি। তাঁদের মতে, শেরে বাংলার ঐতিহাসিক এলাকার নাম ভাঙিয়ে তিনি চাখারীর উপাধি নিয়েছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বাবুল সরদার চাখারী একসময় ঢাকার পল্টন এলাকায় ভ্যানে জামাকাপড় বিক্রি করতেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি বিভিন্ন ছোট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভে সচেষ্ট থাকেন। একপর্যায়ে জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত হলেও সেখানে সুবিধা করতে না পেরে আবারও নানা ক্ষুদ্র দল ও রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পরে কর্পোরেট উপহার সামগ্রীর ব্যবসা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে নিয়োগ, বদলি ও টেন্ডার-ভিত্তিক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। অভিযোগ রয়েছে, গত সরকারের আমলে তিনি ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দেওয়ার একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটও নিয়ন্ত্রণ করতেন।
চাখারেই তাঁর আসল পরিচয় ফাঁস :
চাখারের স্থানীয় বাসিন্দারা বাবুল সরদারকে প্রতারক ও সুযোগসন্ধানী বলেই চেনেন। চাখারের বাসিন্দা ভ্যানচালক শাহিন বলেন, কয়েক বছর আগে বাবুল একটি গাড়ি ভাড়া করে এলাকায় আসেন। চারদিন পার হলেও গাড়ি ভাড়ার টাকা না দেওয়ায় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সামনে বাবুল ও সেই গাড়ির ড্রাইভারের মারামারি হয়।
আরেক ব্যবসায়ী সৈয়দ তাজুল ইসলাম ফেসবুক পোস্টে লিখেন, আমরা তখন তাঁকে আওয়ামীলীগ হিসেবেই চিনতাম, ২০০৮/০৯ সালে বাবুল স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষকের ওপর হামলার চেষ্টা করেন। সেদিন স্থানীয়দের হস্তক্ষেপেই শিক্ষক বেঁচে যান।
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের আহবায়ক কমিটির সদস্য ফাইজুল ভুঁইয়া বিগত সরকারের সময়ের একটি ভিডিও শেয়ার করে লিখেন ‘বড় ভাই কট’। জানা যায় যুবদলের এ নেতার বাড়ি চাখারে যদিও ‘মহাপ্রতারক’ আখ্যা দিয়ে তাঁর বিষয়ে কথা বলতে আনাগ্রহ দেখান। সেখানে স্থানীয় অনেকেই মন্তব্য করেন বাটপার ও প্রতারক বলে।
সাংগঠনিক পরিচয়ে পরিবারতন্ত্র :
বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদারের স্ত্রী নাজমা আক্তার দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ভাই জসিম সরদার মহাসচিব। জানা গেছে, জসিম একসময় চাখারে মুদি দোকান চালাতেন। বড় ভাইয়ের হাত ধরে তিনিও ঢাকায় এসে ‘রাজনীতিক’ হয়ে ওঠেন।
ভুয়া এমপি পরিচয় দিয়ে প্রতারণা :
২০১৮ সালের ১৬ মে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে ৫ কোটি টাকার বিল মওকুফ করানোর চেষ্টা করেন বাবুল। নিজেকে বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস হিসেবে পরিচয় দেন। সন্দেহ হলে আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন সরাসরি এমপি ইউনুসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভুয়া পরিচয় ফাঁস হলে বাবুলকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
আলাপের ভিত্তিতে কোটি টাকার প্রতারণা অভিযোগ :
চাখার, শলিয়া বাকপুর ও মাদারকাঠি এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, বিগত সরকারের সময় বাবুল চাকরি দেওয়ার নামে কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নেন। পরে প্রতিশ্রুতি পূরণ না করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
ভিডিও ভাইরাল ও প্রতিক্রিয়া :
সম্প্রতি একটি ভিডিওতে বাবুল সরদার চাখারীকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করতে দেখা যায়। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। ঢাকার এক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, বাবুল তাঁকে বাসায় বন্দি করে অর্থ আদায় করেছেন, চাখার ও আশপাশের এলাকায় বাবুল চাখারীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ। স্থানীয়দের মতে, তিনি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপকর্মে জড়িয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন