মতপ্রকাশে শাস্তির সংস্কৃতি বদলাচ্ছে, বাতিল হচ্ছে বিতর্কিত ধারা

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সংবাদ সম্মেলন বক্তব্য রাখেন, ছবি - পিআইডি।
সাইবার অপরাধ দমন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়নের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। ‘কালাকানুন’ হিসেবে সমালোচিত আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা বাতিল করে এবং কিছু নতুন ধারা যুক্ত করে তৈরি হয়েছে এই অধ্যাদেশের খসড়া।
মঙ্গলবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশটি অনুমোদন পায়। বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়াটি ২৫ বার পরিমার্জন করা হয়েছে। সিভিল সোসাইটির সঙ্গে তিন ঘণ্টার আলোচনা শেষে তাদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একটি সংশোধনী প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে গেজেট প্রকাশ করা হবে।
প্রস্তাবিত নতুন আইন অনুযায়ী, প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনলাইন জুয়া। সাইবার জগতে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আইনে সাইবার স্পেসে জালিয়াতি, ব্ল্যাকমেইল, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো, ঘৃণামূলক বক্তব্য ও যৌন হয়রানি সংক্রান্ত অপরাধগুলো জামিনযোগ্য করা হয়েছে। মতপ্রকাশ সংশ্লিষ্ট সব অপরাধের ক্ষেত্রেই জামিনযোগ্যতার বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া নতুন আইনে একটি ‘সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। এই কাউন্সিল আক্রমণাত্মক ও অপরাধমূলক কনটেন্ট অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে, তবে অপসারণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালতের অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন না মিললে কনটেন্ট পুনরায় প্রকাশ করতে হবে এবং অপসারণের বিষয়টি জনগণকে জানাতে হবে।
আগের ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’-এর যেসব ধারা অপব্যবহারের জন্য সমালোচিত হয়েছিল, সেগুলো এই নতুন আইনে বাদ দেওয়া হয়েছে। আইন উপদেষ্টা জানান, বাতিল করা নয়টি ধারায়ই আগের আইনের ৯৫ শতাংশ মামলা দায়ের হয়েছিল। এসব মামলা এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
বিশেষভাবে বাতিল করা ধারার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় পতাকা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে শাস্তির বিধান, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর অভিযোগে মামলার সুযোগ।
সাংবাদিকদের ওপর আগের আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা।
নতুন আইনে শুধুমাত্র দুই ধরনের ‘স্পিস অফেন্স’ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে: প্রথমত, নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নমূলক কনটেন্ট প্রকাশ এবং হুমকি প্রদান; দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানো যার মাধ্যমে সহিংসতায় উসকানি দেওয়া হয়।
অধ্যাদেশে উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয় হলো—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে সংঘটিত সাইবার অপরাধকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমবার।
নারী ও শিশুর প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগের ক্ষেত্রেও রক্ষাকবচ রাখা হয়েছে। এসব মামলা আমলি আদালতে যাবে এবং বিচারক যদি মনে করেন মামলাটি ভিত্তিহীন, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেটি খারিজ করতে পারবেন। অভিযোগপত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নিয়ে দেশ-বিদেশে তীব্র সমালোচনা হয়। লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু এবং একাধিক সাংবাদিককে হয়রানির ঘটনায় এই আইনের অপব্যবহার স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে আইনটির নাম বদলে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ করা হলেও, মূল কাঠামো অপরিবর্তিত থাকায় সমালোচনা থামেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আইনের সংস্কার ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে কালাকানুন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। তারই অংশ হিসেবে এই নতুন ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ প্রণয়ন করা হলো।
আপনার মতামত লিখুন