মহিপালে জুলাইয়ের রক্তাক্ত স্মৃতি: নিহত ৭, ২২ মামলা, বিচার অধরাই

ফেনীর মহিপাল উড়ালসেতুর নিচে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হয় নজিরবিহীন হামলা। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, ১৭ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগ। কিন্তু আন্দোলনের সেই দিন পরিণত হয় বিভীষিকায়।
আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ওইদিন ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করে ৭ তরুণকে—ইশতিয়াক আহম্মেদ শ্রাবণ (ফুলগাজী), সারওয়ার জাহান মাসুদ (দাগনভূঞা), মাহবুবুল হাসান মাসুম ও জাকির হোসেন শাকিব (সোনাগাজী), সাইদুল ইসলাম ও ওয়াকিল আহম্মেদ শিহাব (ফেনী সদর) এবং মোহাম্মদ সবুজ (ফেনী পৌর এলাকা)।
এছাড়া আহত হন অন্তত দেড় শতাধিক ছাত্র-জনতা।
আহতদের মধ্যে দাগনভূঞার তাজিম উদ্দিন, নাসির উদ্দীন, ফেনী সদরের মহিউদ্দিন, আবু জাফর, বাহার মিয়া, আবদুর রব, রিয়াজ, সোনাগাজীর বোরহান উদ্দিন, আহাদ, জামশেদুল, ফরহাদ হোসেনসহ অনেকে ছিলেন। মহিপাল পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।
ফেনী জেনারেল হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ ও আহতদের সেবা দিতে হিমশিম খায় পুরো চিকিৎসা দল। সিনিয়র স্টাফ নার্স তরিকুজ্জামান জানান, “জরুরি বিভাগ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। যে যেভাবে পেরেছে, সেবা দিয়েছে।”
ফেনী জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় দায়ের হওয়া ২২ মামলার মধ্যে ৭টি হত্যা মামলা এবং ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা। এজাহারে নাম রয়েছে ২ হাজার ১৯৯ জনের, অজ্ঞাত হিসেবে আরও ৪ হাজার।
অভিযোগ রয়েছে, ফেনীর তিন সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী (ফেনী-২), আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিম (ফেনী-১), ও মাসুদ উদ্দিন (ফেনী-৩) সহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম এসব মামলায় রয়েছে। এমনকি এক মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নামও রয়েছে।
অন্য অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন: ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, ছাগলনাইয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার সোহেল, জেলা যুবলীগের সভাপতি দিদারুল কবির রতন, সোনাগাজীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন, যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম পিটু, জিয়া উদ্দিন বাবলু প্রমুখ।
শহীদ শ্রাবণের বাবা নেছার আহম্মদ বলেন, “আমরা শুধু বিচার চাই। সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়। অভিযুক্তরা কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, বাকিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, “আমাদের সাজানো জীবন এক মুহূর্তেই ভেঙে গেছে। এখন শুধু একটাই আশা—ন্যায়বিচার।”
আইনজীবী মেজবা উদ্দিন ভুঞা বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী হামলাকারীরা ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। কিন্তু মামলার ৬ হাজারের বেশি আসামির মধ্যে যারা মূল পরিকল্পনাকারী, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, “১ হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ১১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একটি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, অন্য মামলাগুলোর তদন্ত চলমান।”
তবে ক্ষোভের জায়গা এখানেই—এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো বড় রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, বরং অনেকেই রয়েছেন বিদেশে।
শহীদদের পরিবার ও সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলে আইন-শৃঙ্খলা ও মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়বে।
আপনার মতামত লিখুন