হারবার্টের স্রষ্টা, দ্রোহের ভাষ্যকার: নবারুণকে স্মরণ

তৌফিক পলাশ :
প্রকাশ: ২৩ জুন, ২০২৫, ৩:৫৬
হারবার্টের স্রষ্টা, দ্রোহের ভাষ্যকার: নবারুণকে স্মরণ

নবারুণ ভট্টাচার্য,- ফাইল ছবি।

বাংলা ভাষার সাহসী কবি, প্রতিবাদী লেখক ও বিকল্প সাহিত্যচিন্তার পুরোধা নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। কবির জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন, বিখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য ও লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর সন্তান হিসেবে এক সাহিত্যস্নাত পরিবেশে। তবে নিজের অবস্থান তিনি তৈরি করেছেন আলাদা স্বরে, বিপ্লবী মননে, ভাষার ভাঙনে, নির্মাণে ও নবরূপে।

নবারুণ মূলধারার কাব্যচর্চা কিংবা তথাকথিত সাহিত্যিক আড়ম্বরকে কখনোই অনুসরণ করেননি। তার কাব্যভাষা ছিল প্রতিবাদী, অশান্ত, কখনো শ্লেষে ভরা, আবার কখনো ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপে বিদ্ধ। ‘ফ্যাঁসিবাদবিরোধী লেখক’ হিসেবেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যিক চেতনায় ছিল মার্কসবাদ, কিন্তু তা কোনো আদর্শিক বর্ণনাবাদ নয় বরং প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পংক্তি যেন শ্রেণিচেতনার বারুদে রূপান্তরিত।

নবারুণের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ হারবার্ট’ যেটি পরে চলচ্চিত্রেও রূপ পেয়েছিল একটি নতুন ধরনের সাহিত্যের পথ খুলে দেয় বাংলা সাহিত্যে।

সমাজের প্রান্তিক, বিদ্রোহী, পাগল বলে গালি খাওয়া চরিত্রগুলোকে তিনি তুলে আনেন এমন এক কাব্যভাষায়, যেখানে বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা একে অপরকে আচ্ছন্ন করে। হারবার্ট-এর জন্য তিনি পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার, কিন্তু সেই পুরস্কারও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবাদের ভাষায়।

তার কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, এমনকি ছোট গল্পেও বারবার উঠে এসেছে রাজনীতি, ফ্যাসিবাদ, রাষ্ট্রের নিপীড়ন, এবং সর্বোপরি মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রশ্ন।

নবারুণ বলতেন, ‘ আমি নই, আমার কবিতাই প্রতিবাদ করে।’

এই আত্মবিচ্ছিন্নতা ছিল না আত্মদ্রোহ, বরং নিজের অস্তিত্বকে সাহিত্যে দ্রোহের অস্ত্রে পরিণত করার অনন্য দক্ষতা।

নবারুণের জন্মদিনে তাঁকে শুধুমাত্র ‘স্মরণ’ করলেই চলবে না, বরং তাঁর সাহস ও সততার সাহিত্যচিন্তাকে আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন করে মূল্যায়ন করাও জরুরি। আজ, যখন সমাজ আবার ভয়, দমন আর নিপীড়নের ছায়ায় আচ্ছন্ন, তখন তাঁর ভাষা, তাঁর প্রতিবাদ, তাঁর নির্মোহ সত্য উচ্চারণ যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

তাঁর লেখা একবার পড়লে পাঠককে নেড়ে দেয়, তাড়িত করে, জাগিয়ে তোলে। তার সাহিত্যে কোনো কৃত্রিম গ্ল্যামার নেই, আছে স্পষ্ট উচ্চারণ, অস্বস্তিকর প্রশ্ন আর বিদ্রুপের হাসি।

নবারুণ ভট্টাচার্য কেবল একজন কবি বা লেখক নন, তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘চেতনাসত্তা’র ভেতরে স্থাপন করে গেছেন এক অনড় প্রতিরোধের ঘর।