নীতি সহায়তা বন্ধ হতেই লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

বিশেষ প্রতিনিধি :
প্রকাশ: ১৭ জুন, ২০২৫, ৪:৪৬
নীতি সহায়তা বন্ধ হতেই লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

নীতিসহায়তার নামে মন্দ ঋণকে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ বন্ধ হতেই লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে শ্রেণিকৃত (বিরূপমান) ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অথচ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এই পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১৫ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পরই সাবধান করেছিলেন যে, খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বাড়বে। ফেব্রুয়ারিতে তিনি আরও বলেন, ‘কোনো তথ্য গোপন করা হবে না, প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাবে।’ তাঁর পূর্বাভাস অনুযায়ীই, নীতি সহায়তা প্রত্যাহারের পর থেকেই খেলাপির প্রকৃত মাত্রা প্রকাশ পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, পাঁচটি প্রধান কারণে খেলাপি ঋণ এই হারে বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, মেয়াদি ঋণখেলাপির সময়সীমা পুনঃনির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কিছু বড় অঙ্কের ঋণ শ্রেণিকৃত হিসেবে শনাক্ত হওয়া, চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতপশিলকৃত ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ না হওয়া এবং পুরোনো খেলাপি ঋণের ওপর সুদ যোগ হয়ে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া।

এর পেছনে আরও একটি বড় কারণ হলো, আগের সরকারের সময় বিভিন্ন নীতিসহায়তার মাধ্যমে খেলাপি ঋণকে ‘নিয়মিত’ দেখানোর সুযোগ ছিল। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এসব সুবিধা বন্ধ করতে বাংলাদেশকে শর্ত দেওয়া হয়। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ লুকিয়ে রাখার সুযোগ আর নেই। এই প্রক্রিয়ায় এতদিন গোপন থাকা বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ প্রকাশ্যে আসছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩০ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। কিন্তু একই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। শুধু ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা মার্চ শেষে পৌঁছায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটিরও বেশি।

সরকার পরিবর্তনের আগে, ২০২৩ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। সেই তুলনায় ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা, প্রায় দ্বিগুণ।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। বিগত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক দখল করে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। সেই অর্থ আর ফেরত আসেনি। এমন কিছু দখলকৃত ব্যাংকে খেলাপির হার ৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে। যেখানে আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল।

২০২৪ সালের মার্চে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শ্রেণিকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি হয়েছে ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা (১৪.৪৭ শতাংশ) এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ৩ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৪.৮৩ শতাংশ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি অনুযায়ী ব্যাংক খাত পরিচালিত হলেও ২০১৪ সালের নির্বাচন ঘিরে ঋণ পুনঃতপশিল সুবিধা চালু হয়। পরবর্তীতে একের পর এক ছাড় দিয়ে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় গুটিকয়েক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে। এসব অনিয়মের ফলে পুরো ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।

এখন সেই ‘লুকিয়ে রাখা’ খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাচ্ছে, যা খেলাপির হারে ভয়াবহ উল্লম্ফনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।