গোপালগঞ্জে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা পায়নি পর্যবেক্ষণ দল

ফাইল ছবি।
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত সমাবেশে হামলা, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনার পর ওই এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন ১১ সদস্যের নাগরিক পর্যবেক্ষণ দল। তাঁরা এক বিবৃতিতে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা তাঁরা খুঁজে পাননি এবং সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ঘটেছে কি না, তা যাচাইয়ে একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য তদন্ত জরুরি।
১৬ জুলাই গোপালগঞ্জ শহরে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচজন নিহত হন এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ২২ জুলাই গোপালগঞ্জে যান পর্যবেক্ষণ দলটি।
পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা হলেন: আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, মোশাহিদা সুলতানা, রুশাদ ফরিদী, আইনজীবী সারা হোসেন ও মানজুর আল মতিন, সাংবাদিক তাসনিম খলিল, শিল্পী বীথি ঘোষ, লেখক ফিরোজ আহমেদ ও অধিকারকর্মী নাফিউল আলম। দলে আরও একজন সাংবাদিক ছিলেন, যিনি নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।
আজ শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তাঁরা তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরেন।
উত্তেজনার পেছনের প্রেক্ষাপট
পর্যবেক্ষণ দল জানায়, তাঁরা স্থানীয় বাসিন্দা, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের মতে, সংঘর্ষের আগে আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও এনসিপির সমর্থকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনাকর প্রচার চলছিল।
স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টরা এনসিপির সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা দিচ্ছিল। একাধিক ইউটিউবার ‘টুঙ্গিপাড়া ভাঙার’ হুমকি দিয়েছেন, এনসিপির নেতারা হাতুড়ি ও ভেকু নিয়ে আসার কথা বলেছেন। যদিও এনসিপির ছাত্র-সমর্থকেরা “মার্চ টু গোপালগঞ্জ” নামের কোনো বিশেষ তাৎপর্য মানেন না, স্থানীয় অনেকে এটাকে উসকানিমূলক বলেই দেখেছেন।
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী জানান, আওয়ামী লীগ-সমর্থকদের প্ররোচনাই ছিল উত্তেজনার মূল কারণ। তাঁরা মনে করেন, এনসিপির পক্ষ থেকে ওই উত্তেজনায় ভূমিকা রাখার মতো বক্তব্য ছিল না। তবে তারা স্বীকার করেন, এনসিপির কিছু নেতার বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে।
সংঘর্ষের সময় কী ঘটেছিল
পর্যবেক্ষক দলকে স্থানীয়রা জানান, সমাবেশ শুরুর আগেই ৪০-৫০ জনের একটি দল মঞ্চ ভাঙচুর করে। পুলিশের একটি গাড়ি পোড়ানো হয়, কোটালীপাড়ায় ইউএনওর গাড়িও ভাঙচুর হয়। গোপালগঞ্জমুখী সড়কগুলোতে গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্টরা দেশীয় অস্ত্র, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করেছে বলে পুলিশের দাবি। তবে পর্যবেক্ষণ দল এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি। কারও কাছ থেকে জনতার মধ্যে গুলি করতে দেখার কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য মেলেনি।
স্থানীয়রা জানান, ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগান উত্তেজনা আরও বাড়ায়। এই স্লোগান শুনে কয়েক হাজার মানুষ সমাবেশস্থলে চলে আসে। পুলিশের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহারের পরও ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনীকে তলব করতে হয়।
একপর্যায়ে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এরপর জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
এনসিপির নেতারা পর্যবেক্ষক দলকে জানিয়েছেন, পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হবে জানলে তাঁরা সেখানে যেতেন না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সঠিক সতর্কতা না পাওয়ার কারণেই তাঁরা আটকা পড়েছিলেন।
সংঘর্ষ-পরবর্তী পরিস্থিতি
ঘটনার পর গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারি হয়। পুলিশের দাবি, প্রায় ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গণমাধ্যমের সূত্র মতে, ১০ হাজারের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১৮ শিশুকে সন্ত্রাস দমন আইনে অভিযুক্ত করে যশোরের শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।
পর্যবেক্ষণ দল আহতদের সাক্ষাৎকার নিতে পারেননি এবং সময়ের অভাবে ময়নাতদন্ত সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন।
সরকার একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে ২৪ জুলাই যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছে, তাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর সদস্য রয়েছেন। কিন্তু বিবৃতিতে বলা হয়, এই সদস্যদের বিরুদ্ধেই বলপ্রয়োগের অভিযোগ থাকায় তাঁদের তদন্তে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
নাগরিক পর্যবেক্ষণ দলের সুপারিশসমূহ :
১. সমাবেশে হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২. সব রাজনৈতিক দলের উসকানিমূলক বক্তব্য পরিহার করা জরুরি।
৩.গ্রেপ্তার ও মামলার ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে; শিশুদের প্রতি বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।
৪.নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা এবং প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে যৌক্তিকতা নেই—তাই একটি নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি।
৫. অভিযুক্ত বাহিনীর সদস্যদের ছাড়া তদন্ত কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
৬.গুজব ছড়ানো বন্ধে এবং কোনো ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী বা অঞ্চলকে লক্ষ্য করে উসকানিমূলক বক্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭.মানবাধিকার কমিশনকে পুনর্গঠন ও কার্যকর করতে হবে।
৮.যাতে কোনো নিরীহ ব্যক্তি হয়রানির শিকার না হন, শিশুদের অধিকার রক্ষা পায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত হয়—সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন