আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ৯ মাস পর

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার নয় মাসের মাথায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ী হিসেবে অভিযুক্ত দলটির সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
শনিবার (১০ মে) রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে, যাতে রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর বিচারিক ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সকল কার্যক্রম স্থল ও সাইবার স্পেসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এছাড়া, অভ্যুত্থানের সময়কার ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে বলেও জানানো হয়।
গত বছরের আগস্টে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতিত হয়। অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ওই অভ্যুত্থানে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সমর্থিত সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় ১,৪০০ জন নিহত হন এবং কয়েক হাজার আহত হন।
দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের অভিযোগ থাকলেও অভ্যুত্থানের পরও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করা হয়নি। উল্টো তারা সামাজিক মাধ্যমে অভ্যুত্থানকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে সমন্বিত অপপ্রচার চালাতে থাকে, যার ফলে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীরা।
৭ মে মধ্যরাতে হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের গোপন দেশত্যাগের ঘটনায় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরদিন ৮ মে রাতে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর আহ্বানে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’র সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। এতে অংশ নেয় এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইনকিলাব মঞ্চ, জুলাই ঐক্য, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদসহ গণআন্দোলনের অন্যান্য সংগঠন।
৯ মে জুমার নামাজের পর মিন্টো রোডে একটি অস্থায়ী মঞ্চে সমাবেশ শেষে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। শনিবার রাতে সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে ঘোষণা আসে—বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ।
ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। শাহবাগ, যমুনা ভবন এলাকা, ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে রাজপথ। “টাটা গুড বাই আওয়ামী লীগ”, “স্বৈরাচারের পতন চাই”, “জুলাই হত্যার বিচার চাই”—এমন নানা স্লোগানে প্রকম্পিত হয় রাজধানীর কেন্দ্রস্থল।
আন্দোলনকারী এক ছাত্রনেতা বলেন, “এটা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন না, এটা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করার প্রথম পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ মানে গণতন্ত্রের মুক্তি, প্রজন্মের নিরাপত্তা।”
অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শিগগিরই শুরু হবে। বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন হলে অভিযুক্তদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়া হবে। একইসাথে, আন্দোলন থেকে উঠে আসা দাবি অনুযায়ী নতুন সংবিধান রচনার লক্ষ্যে গণপরিষদ গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনায়।
আপনার মতামত লিখুন