ফেনীর দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্তনাদ, টেকসই বাঁধের দাবি সর্বত্র

আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফেনী:
প্রকাশ: ১৩ জুলাই, ২০২৫, ৬:২৬
ফেনীর দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্তনাদ, টেকসই বাঁধের দাবি সর্বত্র

বন্যা এসেছে, পানি নামছে—তবে দুর্ভোগ থামেনি। ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার প্লাবিত মানুষ ঘরে ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু ফিরেছে এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। কর্দমাক্ত ঘর, পঁচা খাবারের দুর্গন্ধ, ভাঙা আসবাব আর বিদ্যুৎহীন জীবনে শুরু হয়েছে বেঁচে থাকার নতুন যুদ্ধ।

বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও অনেকটাই খালি। তবু এখনো ৯টি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১৩০টি পরিবারের ৪৮৪ জন মানুষ। এর বাইরে অন্তত ৯ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে ধসে পড়া জীবন নতুন করে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন।

ঘরবাড়িতে এখনও কাদা, দুর্গন্ধ, অনেকে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়। ফুলগাজীর ইউএনও ফারিয়া ইসলাম বলছেন, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসহ প্রয়োজনীয় সেবা ফেরাতে কাজ করছে প্রশাসন। কিন্তু বাস্তবতা হলো—পানি কমলেও ঘরগুলো এখনো বসবাসের উপযোগী নয়।

গত ৮ জুলাই থেকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত হয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে। এতে জেলার ৪ উপজেলার ১৩৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়, যেগুলোর মধ্যে এখনো কিছু এলাকাতে পানি রয়ে গেছে।
জেলার প্রশাসনিক হিসাবে কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ ছিল পানিবন্দি; এক হাজারের বেশি ঘরবাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত।

ফুলগাজী বাজারের শ্রীপুর সড়কে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত ১৫টি দোকান। দোকান হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী আবদুল আলিম বলছেন, দোকানটাই ছিল জীবনের একমাত্র সম্বল, এখন দাঁড়িয়ে আছি হাওয়ার উপর।

আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা গৃহবধূ রোজিনা আক্তার বলছেন, পানি নেমেছে, কিন্তু ঘরে থাকা যায় না। পঁচা জিনিসের গন্ধে শিশুরাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ৩৬টি স্থানে ভেঙেছে—পরশুরামে ১৯টি, ফুলগাজীতে ১৭টি। নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন জানালেন, জিওব্যাগ দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি নদী খনন ও টেকসই বাঁধ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান নেই।

জেলা কৃষি ও মৎস্য বিভাগের হিসাবে, এবারের বন্যায় ৫,৫৬৪ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি নষ্ট, মৎস্য খাতে ক্ষতি ৮ কোটি টাকার বেশি, প্রাণিসম্পদে ক্ষতি প্রায় ৬৫ লাখ টাকা। সম্পূর্ণ পানি নামার পর এই ক্ষতির চিত্র আরও বড় হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ফুলগাজীর খামারি হারুন বলছেন, মুরগির খামার, মাছের ঘের সব পানিতে তলিয়ে গেছে। গত বছরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। প্রতিবারই প্রতিশ্রুতি পাই, কাজ পাই না।
স্থানীয় মানুষ বলছেন, ‘ত্রাণ নয়, এবার চাই টেকসই বাঁধ।’ সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল রসুল গোলাপ বলেন, নদীখনন, সঠিক তদারকি আর বাঁধ মেরামত ছাড়া আমরা প্রতিবছরই ডুববো।

শনিবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখা উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, মানুষ এখন ত্রাণ চাইছে না, চাইছে স্থায়ী নিরাপত্তা। দুইটিই দরকার—একদিকে বাঁচতে হবে, অন্যদিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

পরশুরামের ইউএনও আরিফুল ইসলাম জানান, ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে, তবে চাহিদার তুলনায় অনেক কিছুই ঘাটতিতে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ত্রাণ কার্যক্রমে এরইমধ্যে সাড়ে ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, আরও ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে শুকনো খাবার, শিশু ও গো-খাদ্যের জন্য। সেনাবাহিনী প্রশাসনকে সহায়তা করছে।

ইএফডি মেশিনের মতো কর আদায়ের ব্যর্থ প্রকল্প, আবার বাঁধ ভাঙা, প্রতিবছরের বন্যা, বারবার বলা—ত্রাণ নয়, বাঁধ চাই, সবই এখন বন্যাপীড়িত জনপদের চেনা বাস্তবতা। অথচ এই বাস্তবতায় বদলের ছাপ এখনও নেই।

ক্ষতির হিসাব জমছে, মানুষের আশা জিইয়ে আছে—তবে সরকার কী এবার ভাঙা বাঁধ আর ভাঙা বিশ্বাস জোড়া লাগাবে?