ধারাবাহিক ছন্দপতন, কোন পথে বাংলাদেশের ক্রিকেট?

জোবায়ের আহমেদ :
প্রকাশ: ২ জুন, ২০২৫, ৫:১৮
ধারাবাহিক ছন্দপতন, কোন পথে বাংলাদেশের ক্রিকেট?

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক চিত্র এক ধরনের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি। গত কয়েক বছর ধরে দলের পারফরম্যান্সে দেখা যাচ্ছে ধারাবাহিকতা নিম্নমুখী প্রবণতা। একসময় যেসব আশা আর প্রত্যাশা নিয়ে দলটি গড়ে উঠেছিল, সেই আত্মবিশ্বাস এখন আর দেখা যাচ্ছে না মাঠে। জয়ের চেয়ে পরাজয়, সুশৃঙ্খল ক্রিকেটের চেয়ে এলোমেলো সিদ্ধান্ত আর ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত ফর্ম ও মনোভাব ঘিরে জন্ম নিচ্ছে নানা প্রশ্ন।

সর্বশেষ পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশের হোয়াইটওয়াশ হওয়া একটি বড় ধাক্কা দেশের ক্রিকেটের জন্য। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে একটিতেও জয়ের দেখা পায়নি সাকিব-হৃদয়রা। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং—তিন বিভাগেই ছিল ছন্দপতনের ছাপ।

বিশেষ করে ব্যাটারদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ইনিংস, উইকেট ধরে রাখার ব্যর্থতা ও পরিকল্পনাহীন স্ট্র্যাটেজি পুরো দলকেই ব্যাকফুটে ফেলে দেয়। সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগেনি, আবার তরুণরাও কাঙ্ক্ষিত জ্বলে উঠতে পারেনি। বোলাররা কিছুটা লড়াই করলেও রান ডিফেন্ড করার মতো সামর্থ্য ও আগ্রাসন দেখা যায়নি।

ফলাফল হিসেবে পাকিস্তানের মাটিতে আরেকটি হোয়াইটওয়াশ। শুধু পরাজয় নয়, এই হার দেশের ক্রিকেটের কাঠামোগত দুর্বলতা, পরিকল্পনার অভাব এবং নেতৃত্বের সংকট আরও স্পষ্ট করে তোলে।

গত বিশ্বকাপে বাজে পারফরম্যান্স, ঘরোয়া লিগের মানহানি, নেতৃত্বে অস্থিরতা, নির্বাচকদের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আর বোর্ডের রাজনৈতিক প্রভাব—সবকিছু মিলিয়ে আজ প্রশ্ন উঠছে, কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট?

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টিকে থাকতে হলে শুধুমাত্র প্রতিভা নয়, প্রয়োজন সুসংগঠিত কাঠামো, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং আধুনিক ক্রিকেট ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এসব জায়গায় ঘাটতি এখন স্পষ্ট। বারবার অধিনায়ক বদল, পরিকল্পনা ছাড়াই কোচ পরিবর্তন, অদক্ষ নির্বাচক প্যানেল এবং তরুণ খেলোয়াড়দের বিকাশে অব্যবস্থাপনা বোর্ডের দিশাহীনতা প্রমাণ করে।

নানা প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে এলেও, তাদের ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে না পারার পেছনে রয়েছে পরিচর্যার অভাব ও চাপ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা। একদিকে অভিজ্ঞদের প্রতি অতি নির্ভরতা, অন্যদিকে তরুণদের পর্যাপ্ত সুযোগ না দেওয়া দুই দিক থেকেই দল পড়ছে দোলাচলে। সিনিয়র ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স ঘিরেও রয়েছে প্রশ্ন। ফর্মহীনতা, ইনজুরি আর আত্মবিশ্বাসের সংকটে ভুগছে অনেকেই। অন্যদিকে তরুণরা অভিজ্ঞতা ও মানসিক প্রস্তুতির ঘাটতিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের প্রমাণ করতে পারছে না।

ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকা নিয়েও উঠছে জোরালো প্রশ্ন। পরিচালনায় স্বচ্ছতা নেই, নেই পেশাদারিত্ব। একাধিকবার বোর্ডের ভেতরেই দ্বন্দ্ব, পক্ষপাতদুষ্টতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ উঠেছে। বোর্ডের অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতা শুধু মাঠেই নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটের মানকেও নিচে নামিয়ে দিয়েছে। জাতীয় লিগ, বিসিএল, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ—সব জায়গাতেই অনিয়ম, দুর্বল অবকাঠামো, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং ফিক্সিংয়ের অভিযোগ খেলোয়াড় ও দর্শকদের আস্থা নষ্ট করেছে।

আরেকটি বড় সংকট হলো দলীয় সংস্কৃতি বা টিম কালচার। সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন, ড্রেসিংরুমে বিশ্বাসের ঘাটতি এবং ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে ক্রিকেটারদের দূরত্ব পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বারবার কোচিং স্টাফ বদলালেও, মাঠে তার ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যায়নি। একজন কোচের হাতে দলের দায়িত্ব না দিয়ে বারবার পরীক্ষার ছুরি চালানো হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানের কোনো দলের জন্য অগ্রহণযোগ্য।

সবশেষে, বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে হয় নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যাবে, নতুবা আরও পিছিয়ে পড়বে দলটি। এর থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো পরিকল্পিত, পেশাদার, স্বচ্ছ ও সাহসী পদক্ষেপ। শুধুমাত্র আবেগ নয়, প্রয়োজন বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত।

তরুণদের পরিচর্যা, সিনিয়রদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ঘরোয়া ক্রিকেটের মানোন্নয়ন, সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন এবং বোর্ডের পেশাদার রূপান্তর এসবই হতে হবে জরুরি প্রাথমিক পদক্ষেপ। তা না হলে ‘ধারাবাহিক ছন্দপতন’ বাংলাদেশের ক্রিকেটে দীর্ঘস্থায়ী দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।